শেয়ার বাজার একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের মাধ্যম। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জনের জন্য তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি প্রায়োগিক জ্ঞানও প্রয়োজন। বিনিয়োগের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করার পূর্বে এ সংক্রান্ত যথাযথ বিশ্লেষণ করে নেয়া অত্যন্ত জরুরী। শেয়ার মার্কেট এনালাইসিস করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা প্রধানত যে দুই ধরনের এনালাইসিস ব্যবহার করে থাকেন তার একটি হচ্ছে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এবং অপরটি টেকনিক্যাল এনালাইসিস। আসুন জেনে নেই টেকনিক্যাল এনালাইসিস কী এবং এটি কিভাবে কাজ করে।
টেকনিক্যাল এনালাইসিস কী?
একটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য উঠানামার গানিতিক বিশ্লেষনকেই টেকনিক্যাল এনালাইসিস বলে। টেকনিক্যাল এনালাইসিসের মূল ভিত্তি হলো পূর্বের মূল্যের গতিবিধি পর্যালোচনা করা ও তার উপর ভিত্তি করে বর্তমান ট্রেডিং কন্ডিশনে মূল্য কোন পর্যায়ে আছে তা নির্ধারন করা এবং সেই সাথে নিকট ভবিষ্যতে মূল্যের সম্ভাব্য মুভমেন্ট সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়া। ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এর মতো এখানে কোন কোম্পানির আর্থিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করা হয় না।
টেকনিক্যাল এনালাইসিস কীভাবে কাজ করে?
আপনি যখন কোন রাস্তা সম্পর্কে ঠিকভাবে না জেনেই অচেনা রাস্তায় চলতে শুরু করেন তখন সেই রাস্তায় ভুল হবার সম্ভবনা বেড়ে যায় অনেকটাই। তেমনিভাবে একজন বিনিয়োগকারীকেও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সঠিক পথ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখতে হয়। টেকনিক্যাল এনালাইসিস শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুবিধার্তে অনেকটা নকশার মতো কাজ করে। টেকনিক্যাল এনালাইসিসের মূল ভিত্তি হলো বিভিন্ন ধরনের চার্ট প্যাটার্ন যা একজন বিনিয়োগকারীকে ভবিষ্যতের মূল্য সম্পর্কে অনুমান করতে সহায়তা করে। একজন বিনিয়োগকারী যদি টেকনিক্যাল এনালাইসিস এ দক্ষ হয় এবং বিগত সময়ের মার্কেট প্যাটার্ন গুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারেন তবে তিনি ভবিষ্যৎ দামের গতিবিধির সম্পর্কে একটি ধারণা করতে পারবেন। তাই ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল এনালাইসিস খুবই কার্যকরী।
আপনারা নিশ্চয়ই একটি প্রাচীন প্রবাদ শুনে থাকবেন “History tends to repeat itself”। এটিই টেকনিক্যাল এনালাইসিস এর সারসংক্ষেপ কারণ টেকনিক্যাল এনালাইসিসের বিশ্বাস হলো পূর্বে যেসব প্যাটার্ন তৈরি হওয়ার পর মার্কেট যেভাবে আচরণ করেছে ভবিষ্যতেও অনুরূপ প্যাটার্ন তৈরি হওয়ার পর মার্কেট একই ভাবে আচরণ করবে। চার্ট প্যাটার্ন গুলোর মূলে রয়েছে হিউম্যান সাইকোলজি যা সাধারণত পরিবর্তন হয় না এবং তাই এগুলো সচরাচর পূর্বের মত কাজ করে থাকে।
টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর কী?
টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর হচ্ছে কিছু ডাটা পয়েন্টের সিরিজ যা প্রাইসের উপর গানিতিক ফর্মুলা প্রয়োগ করে বের করা হয় এবং একটি কোম্পানির শেয়ারের প্রাইস কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এনালাইসিস করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এগুলো হলো টেকনিক্যাল এনালাইসিসের কিছু উপকরণ যা ট্রেডাররা প্রাইস চার্টে সর্বোত্তম এন্ট্রি এবং এক্সিট পয়েন্ট সনাক্ত করতে ব্যবহার করে থাকেন। টেকনিক্যাল এনালাইসিসের জন্য ইন্ডিকেটরগুলো গ্রাফিক ফরম্যাটে ডাটা পয়েন্ট প্রকাশ করে থাকে।
টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর দুই ধরনের হয় –
লিডিং ইন্ডিকেটর: লিডিং ইন্ডিকেটর কোনো সিকিউরিটিজের প্রাইস মুভমেন্টের সাথেই তৎক্ষণাৎ ডাটা প্রকাশ করে। অধিকাংশ লিডিং ইন্ডিকেটর বিগত একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রাইস ট্রেন্ড এনালাইসিস করে ডাটা প্রকাশ করে। চলমান ট্রেন্ড শক্তিশালী বা দুর্বল হওয়া সম্পর্কে লিডিং ইন্ডিকেটর আগেই ট্রেডারদের সতর্ক করতে পারে। কিছু জনপ্রিয় লিডিং ইন্ডিকেটর হলো- RSI (Relative Strength Index), Stochastic Oscillator ইত্যাদি।
ল্যাগিং ইন্ডিকেটর: ল্যাগিং ইন্ডিকেটর কোনো সিকিউরিটিজের প্রাইস ট্রেন্ড অনুসরণ করে ডাটা প্রকাশ করে। ল্যাগিং ইন্ডিকেটর কে ট্রেন্ড ফলোইং (Trend Following) ইন্ডিকেটরও বলা হয়। কোনো সিকিউরিটিজ যখন একটি শক্তিশালী ট্রেন্ডে চলমান থাকে তখন ল্যাগিং ইন্ডিকেটর ভালো কাজ করে। কয়েকটি জনপ্রিয় ল্যাগিং ইন্ডিকেটর হলো- Moving Average, MACD (Moving Average Convergence Divergence) ইত্যাদি।
কোন সিকিউরিটিজের প্রাইস চার্ট এনালাইসিস করার পাশাপাশি টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটরও ব্যবহার করা উচিত। প্রাইস চার্ট এনালাইসিস করে একজন ট্রেডার যে সিদ্ধান্ত নেয়, ইন্ডিকেটর অনেক সময় এর বিপরীত সিগন্যাল দিয়ে থাকে।
দুটি ভিন্ন ধরনের ইন্ডিকেটর একই সাথে Buy/Sell সিগনাল দিলে ঐ সিগন্যালটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই একজন টেকনিক্যাল এনালিস্টের প্রথমে প্রাইস চার্ট এনালাইসিস করে তারপর একাধিক ইন্ডিকেটরের সিগনালের সহায়তায় ট্রেডিং সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
চার্টে একসাথে একাধিক ইন্ডিকেটর ব্যবহার করার পূর্বে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক ইন্ডিকেটর একসাথে ব্যবহার করলে তা একজন ট্রেডারের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। কারণ সব ইন্ডিকেটর একইসাথে একরকম সিগন্যাল দেয়না। এই ক্ষেত্রে কিছু ইন্ডিকেটর Buy সিগনাল এবং কিছু ইন্ডিকেটর Sell সিগন্যাল দিলে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য তা একজন নতুন ট্রেডার বুঝতে পারেনা। এজন্য একসাথে অনেক বেশি ইন্ডিকেটরের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়।
একই ধরনের ইন্ডিকেটর দুইটি ব্যবহার করা অপ্রয়োজনীয়। যেমন, Stochastic Oscillator এবং RSI দুইটি ইন্ডিকেটরেই Overbought এবং Oversold জোন রয়েছে। তাই মোমেন্টাম পরিমাপ করার জন্য একসাথে একই ধরনের দুইটি ইন্ডিকেটর ব্যবহার করা অপ্রয়োজনীয়।
একজন ট্রেডারের তার ট্রেডিং কৌশলের সাথে যেসব ইন্ডিকেটরের সিগন্যাল মিলে যায় সেসব ইন্ডিকেটর ব্যবহার করা উচিত। যেকোনো স্ট্রাটেজির সাথে সব ধরণের ইন্ডিকেটর কখনো মানানসই হয় না। তাই দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণ করে বিনিয়োগের কৌশলের সাথে মিল রেখে সঠিক ইন্ডিকেটর বাছাই করা উচিত।
টেকনিক্যাল এনালাইসিসের সীমাবদ্ধতাঃ
টেকনিক্যাল এনালাইসিস সবসময় সঠিক সিগন্যাল দেয় না। বিভিন্ন টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর ব্যবহার করে নেয়া এন্ট্রি অনেক সময় ঠিকমতো কাজ করে না।
নানা ধরনের ইন্ডিকেটর একত্রে ব্যবহারের সময় একই অবস্থায় কিছু ইন্ডিকেটর বাই সিগন্যাল দেয় এবং কোনটি সেল সিগন্যাল দেয়।
কোম্পানি সম্পর্কে সামগ্রিক ধারনা পাওয়া যায় না, শুধু প্রাইসের মুভমেন্ট সম্পর্কে অনুমান করা যায়।
দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই অ্যানালাইসিস উপযুক্ত নয় ।
শেয়ারবাজারে সফল হতে হলে টেকনিক্যাল অ্যানালাইসিস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একজন বিনিয়োগকারীকে মার্কেটের ট্রেন্ড বুঝতে এবং ভালো এন্ট্রি ও এক্সিট পয়েন্ট বের করতে সাহায্য করে। সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জনে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এর পাশাপাশি টেকনিক্যাল এনালাইসিস অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।
টেকনিক্যাল এনালাইসিস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে রয়্যাল ক্যাপিটাল লিমিটেড এর একটি বই রয়েছে যেটি আপনার বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।