বিনিয়োগ পরিকল্পনায় বৈচিত্রায়ন বা পোর্টফলিও নীতির প্রয়োগ
পোর্টফলিও কী?
পোর্টফলিও বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বিনিয়োগ খাতে আপনার সম্পূর্ণ সঞ্চয় বিনিয়োগ না করে একাধিক লাভজনক খাতে (শেয়ার, সরকারি বন্ড, কর্পোরেট বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, নগদ, স্থায়ী সম্পদ ইত্যাদি) বিনিয়োগ করাকে বোঝায়। পোর্টফলিও নীতি অনুসরণ করে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী তার ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস করতে পারেন। পোর্টফলিও শুধুমাত্র শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি আর্থিক সম্পদে সীমাবদ্ধ নয়, আবাসন, ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্য, শিল্পকর্ম, জমি-জমা, স্বর্ণ ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।
বিনিয়োগে পোর্টফলিও নীতি কেন অনুসরণ করবো ?
বিনিয়োগকারীরা সাধারণত বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস করার উদ্দেশ্যে পোর্টফলিও নীতি অনুসরণ করে থাকেন। কোনো একটি বিনিয়োগ খাতে সম্পূর্ণ সঞ্চয় বিনিয়োগ করা হলে এবং বিনিয়োগটিতে ক্ষতি হলে সেই ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই একটি খাতে বিনিয়োগ না করে একাধিক খাতে বিনিয়োগ করা কম ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ কোনো একটি বা কয়েকটি খাতে ক্ষতি হলেও অন্যান্য খাতগুলোতে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এভাবে ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস পায়।
পোর্টফলিও নীতি সহজ ভাবে বোঝানোর জন্যে এক ঝুড়ি ডিমের উদাহরন খুবই জনপ্রিয়। যদি একটি ঝুড়িতে এক ডজন ডিম রাখা হয় এবং ঝুড়িটি যদি কোনো কারণে পরে যায় সেক্ষেত্রে সবগুল ডিম ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে যদি আপনি এক ডজন ডিমের প্রতিটি আলদা আলাদা ঝুড়িতে রাখা হয় তবে একটি ঝুড়ি পরে গেলে একটি ডিমই ভাঙ্গবে বাকিগুলো অক্ষত থাকবে। ঠিক একইভাবে কোনো একটি খাতে বিনিয়োগ করা হলে তাতে ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেশি হয়। কিন্তু একাধিক খাতে বিনিয়োগ করা হলে ঝুঁকির পরিমাণ বিভিন্ন খাতের মধ্যে বণ্টন হয়ে যায়। এর ফলে একটি বিনিয়োগে ক্ষতি হলে অন্যান্য বিনিয়োগ হতে প্রাপ্ত মুনাফা দ্বারা তা পরিপূরণ করা সম্ভব হয়।
একটি লাভজনক পোর্টফলিও গঠনের ধাপসমূহ:
ধাপ ১: পোর্টফলিওটির উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা
আপনার পোর্টফলিওটি কোন উদ্দেশ্যে গঠন করা হচ্ছে তা শুরুতেই নির্ধারণ করুন। কারণ এর উপর ভিত্তি করে কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা হবে তা নির্ধারণ করা হয়।
ধাপ ২: আপনার ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগযোগ্য খাতসমূহ নির্বাচন করুন
আপনার পোর্টফলিওটির উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার পর আপনাকে বিনিয়োগযোগ্য খাতগুলো নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রতিটি বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে তার সঞ্চয়ের পরিমাণ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই আপনি কী পরিমাণ ঝুঁকি বহন করতে পারবেন তা বিবেচনা করে শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, স্থায়ী সম্পদ ইত্যাদি বিনিয়োগ খাত নির্বাচন করুন।
ধাপ ৩: বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ নূন্যতম রাখা
এক প্রকার বিনিয়োগকারী অল্প সময়ে বার বার শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে পছন্দ করেন। কিন্তু তারা এটা ভুলে যান যে এতে করে লেনদেনের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও কিছু সংখ্যক বিনিয়োগ লাভজনক হওয়ার ক্ষেত্রে সময় লাগে।
ধাপ ৪: কোন খাতে কতটুকু বিনিয়োগ করবেন তা নির্ধারণ করুন
আপনার সঞ্চিত অর্থ কোন খাতে কতটুকু বিনিয়োগ করবেন তা নির্ধারণ করুন এবং নির্ধারিত পরিমাণ অনুযায়ী খাতসমূহে বণ্টন করুন। এই সিদ্ধান্তটি আপনার ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা ও বিনিয়োগের জন্য সঞ্চিত অর্থের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
ধাপ ৫: কোন একটি খাতে সঞ্চয়ের অধিকাংশ বিনিয়োগ না করা
একটি সম্পদ অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ যত বেশি হয়, তার ঝুঁকির পরিমাণ ততটাই বেশি হয়। তাই একটি সম্পদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ যত কম হবে তা হতে মুনাফা লাভের সম্ভাবনা তত বেশি হবে।
ধাপ ৬: সময়ের সাথে আপনার পোর্টফলিওটি সংশোধন করুন
সময়ের সাথে আপনার নির্বাচিত খাতগুলো লাভ বা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যেমন কোন একটি শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি পেলে পোর্টফলিওয়ের অংশগুলোর পরিবর্তন ঘটে। তাই সময় পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পোর্টফলিওতে ভারসম্য ফেরত আনতে হবে।
পোর্টফলিও বিনিয়োগের প্রকারভেদ
যেকোনো খাতে বিনিয়োগ একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিনিয়োগটির সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির অনুপাতে মুনাফার নিশ্চয়তা দেয়। যদি পোর্টফলিওয়ের অন্তর্গত কোনো একটি খাতে ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেশি হয় (যেমন: আবাসন), সেক্ষেত্রে অপর একটি খাতের ঝুঁকির পরিমাণ খুব কম হওয়া বা প্রায় শূন্য (যেমন: ট্রেজারি বন্ড হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে কম ঝুঁকির বিনিয়োগ খাতগুলোর মুনাফার হার খুবই কম। প্রতিটি বিনিয়োগকারী এসকল দিক বিবেচনা করে নিজ ঝুঁকি গ্রহণ ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে তার পোর্টফলিওটি তৈরি করেন। কিন্তু আর্থিক বাজারের বিনিয়োগযোগ্য খাতগুলো ঝুঁকি বিবেচনায় তৈরি করা হয় না। তাই বিনিয়োগকারীদের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে ঝুঁকির ভিত্তিতে পোর্টফলিওকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা হয়:
ঝুঁকিমুক্ত পোর্টফলিও–
ঝুঁকিমুক্ত পোর্টফলিও বলতে ট্রেজারি বন্ড ও এ সম্পর্কিত সিকিউরিটিগুলো নিয়ে গঠিত পোর্টফলিওকে বোঝায়। এই সিকিউরিটিগুলোর ঝুঁকির পরিমাণ প্রায় শূন্য এবং আয়ের হার অত্যন্ত কম।
নিম্নঝুঁকির পোর্টফলিও–
কম ঝুঁকির পোর্টফলিও হল ঝুঁকিমুক্ত সিকিউরিটিগুলোর সাথে কিছু কম ঝুঁকিপূর্ণ সিকিউরিটিয়ের সমন্বয়ে গঠিত পোর্টফলিও যাতে নূন্যতম ঝুঁকির পাশাপাশি ঝুঁকিহীন পোর্টফলিওয়ের তুলনায় বেশি মুনাফা লাভ করার সম্ভাবনা থাকে।
মধ্যম ঝুঁকির পোর্টফলিও–
মধ্যম ঝুঁকির পোর্টফলিও হল উচ্চঝুঁকির সিকিউরিটিগুলোর সাথে কিছু কম ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের সমন্বয়ে গঠিত পোর্টফলিও।
উচ্চঝুঁকির পোর্টফলিও–
উচ্চঝুঁকির পোর্টফলিও বলতে উচ্চঝুঁকির সিকিউরিটিগুলো নিয়ে গঠিত পোর্টফলিওকে বোঝায়। এতে উচ্চঝুঁকির পাশাপাশি আয়ের হার অনেক বেশি হয়ে থাকে।
ঝুঁকিমুক্ত বা কম ঝুঁকিপূর্ণ সিকিউরিটিগুলোর আয়ের হার খুব কম। তাই কোনো বিনিয়োগকারীয়ের পক্ষে অল্প ঝুঁকি গ্রহণ করে অধিক আয়ের আশা করা অমূলক। একজন বিনিয়োগকারীর এই সমস্যা দূর করার জন্য পোর্টফলিও নীতি খুবই কার্যকর। একজন বিনিয়োগকারী পোর্টফলিও নীতি অনুসরণ করে খুব সহজেই ঝুঁকির ভারসাম্য বজায় রেখে বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিক মুনাফা লাভ করতে পারেন।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পোর্টফলিও নীতি অনুসরণের সুবিধাসমূহ
পোর্টফলিও নীতির অনুসরণ করে একজন বিনিয়োগকারী নিম্নোক্ত সুবিধাগুলো পেতে পারেন:
- একজন বিনিয়োগকারী পোর্টফলিও এর সাহায্যে তার ঝুঁকি গ্রহণের ইচ্ছা ও ক্ষমতা পর্যালোচনা করে তার বিনিয়োগ ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
- একজন স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারী পোর্টফলিও এর সাহায্যে তার বিনিয়োগে বিচিত্রতা বা ভিন্নতা আনার জন্য কোন খাতগুলোতে কতটুকু বিনিয়োগ করতে হবে তা বিশ্লেষন করতে পারেন।
- তারল্য ব্যবস্থাপনা প্রতিটি বিনিয়োগকারীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পোর্টফলিও নীতি এই কাজটি খুব সহজেই করতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে বিনিয়োগগুলো হতে একটি নিয়মিত আয় বা মুনাফা নিশ্চিত করা যায়।
- সব কোম্পানির শেয়ারই লভ্যাংশ প্রদান করে না। কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ারকে গ্রোথ শেয়ার বলা হয় কারণ এগুলো সময়ের সাথে প্রবৃদ্ধির নিশ্চয়তা দেয়। একজন বিনিয়োগকারী যদি এর মধ্যবর্তী কোন খাতে বিনিয়োগ করতে চান তবে পোর্টফলিও এর সাহায্যে লভ্যাংশ ও গ্রোথ শেয়ার উভয় খাতেই বিনিয়োগ করতে পারবেন।
- পোর্টফলিওয়ের সাহায্যে একাধিক খাতে বিনিয়োগের ব্যবস্থাপনা, কোন একটি খাতে অধিক বিনিয়োগের ব্যবস্থাপনার তুলানায় সহজ। উদাহরণ স্বরূপ, যদি আপনি কোন একটি কোম্পানির অনেকগুলো শেয়ারে বিনিয়োগ করে থাকেন তবে সবগুলো শেয়ার হতে আয়, লভ্যাংশ, প্রাপ্ত ভোটাধিকার ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। তবে যদি আপনি আপনার সঞ্চয়ের কিছু পরিমাণ শেয়ারে, কিছুটা বন্ডে, বাকিটা অন্য কোন খাতে বিনিয়োগ করা হলে স্বল্প পরিসরে প্রতি খাতের ব্যবস্থাপনা করা সহজ। এতে করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ ও হ্রাস পায়।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পোর্টফলিও নীতি অনুসরণের অসুবিধাসমূহ
পোর্টফলিও নীতির অনুসরণ করে একজন বিনিয়োগকারী যেসকল অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন:
- শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্যের সরবরাহ। যেমন, বিভিন্ন তথ্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে শেয়ারের বাজার মূল্যের গতিবিধি সাপেক্ষে একজন বিনিয়োগকারী নানারকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং এই সিদ্ধান্তগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লাভজনক কিনা তা পর্যালোচনা করেন। তবে পোর্টফলিও এর ক্ষেত্রে প্রতিটি বিনিয়োগ খাতের ঝুঁকিকে আলদাভাবে গণনা করা হয় না বরং সম্পূর্ণ পোর্টফলিও এর ঝুঁকিকে একত্রে হিসাব করা হয়। এর ফলে সঠিক সময়ে বিনিয়োগ খাতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়ে যায়।
- যদি বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে যথাযথ পর্যালোচনা ও হিসাব না করা হয় তবে পোর্টফলিওটি আপনার কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ মুনাফা প্রদানে ব্যর্থ হতে পারে।
- বিনিয়োগের পূর্বে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঝুঁকির বিপরীতে কতখানি মুনাফা পাওয়া যাবে তা গণনা করা খুবই জরুরি। বর্তমানে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীয়ের পক্ষ থেকে বিনিয়োগখাতের ও পোর্টফলিওয়ের ঝুঁকি পর্যালোচনা করে থাকে। তা স্বত্বেও বিনিয়োগকারীকে সর্বোচ্চ লাভজনকতার নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হয় না।
- পোর্টফলিও এর সাহায্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থায়ন এবং অর্থায়ন সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াবলি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। বিভিন্ন রকম শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, আর্থিক বাজার এর পরিস্থিতির সাথে এই বিনিয়োগ খাতগুলোর সম্পর্ক ইত্যাদি মূল্যায়ন করা সাধারণ জনগণের জন্য একটি কষ্টসাধ্য বিষয়।
পোর্টফলিও এর মাধ্যমে বিনিয়োগ করবেন কিনা তা প্রতিটি বিনিয়োগকারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। পোর্টফলিও একজন বিনিয়োগকারীর জন্য বিনিয়োগ সর্বাধিক লাভজনক করার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এর সাহায্যে যেকোনো বিনিয়োগকারী তার ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা অনুযায়ী বিনিয়োগ করে ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেন, সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করতে পারেন এবং বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তার বিনিয়োগ পরিকল্পনায় বৈচিত্র্যতা আনতে পারেন।
A B Nur Muhammad
May 17, 2023প্রচলিত আছে… বুদ্ধি মান লোক সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখে না..”