শেয়ার বাজারে স্টক ট্রেডিং নিয়ে আলোচনায় মার্কেট সেন্টিমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মার্কেট সেন্টিমেন্ট হল শেয়ারবাজারের কোনো নির্দিষ্ট সিকিউরিটিজ বা সম্পূর্ণ বাজার পরিস্থিতির প্রতি বিনিয়োগকারীদের সামগ্রিক মনোভাব বা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। এই মনোভাব ইতিবাচক, নিরপেক্ষ বা নেতিবাচক হতে পারে। একটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা, আন্তর্জাতিক ঘটনা, ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল এনালাইসিস, সংবাদ প্রতিবেদন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এই মার্কেট সেন্টিমেন্ট গঠিত হতে পারে। শেয়ার বাজারের সামগ্রিক ট্রেন্ড এই মার্কেট সেন্টিমেন্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই মার্কেট সেন্টিমেন্ট এনালাইসিস বিনিয়োগকারীদের তাদের ট্রেডিং বা বিনিয়োগ কৌশলে বাজারের সামগ্রিক মনোভাবের প্রভাবগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা করতে পারে। বিনিয়োগকারীরা মার্কেট সেন্টিমেন্ট এনালাইসিস ব্যবহার করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজগুলোর মূল্যের ভবিষ্যত গতিবিধি সম্পর্কে আগাম ধারণা নিতে পারেন।
মার্কেট সেন্টিমেন্ট সবসময় বাজারের মৌলিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে না। টেকনিক্যাল এনালিস্টরা মার্কেট সেন্টিমেন্টের উপর নির্ভর করে তাদের ট্রেডিং সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন কারণ এটি স্বল্পমেয়াদে সিকিউরিটিজের মূল্যের গতিবিধি বুঝতে সাহায্য করে। ট্রেডাররা এন্ট্রি এবং এক্সিট সিগন্যাল সনাক্ত করার জন্য ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল এনালাইসিসের সাথে মার্কেট সেন্টিমেন্টকেও বিবেচনা করে থাকেন। বিভিন্ন টেকনিক্যাল ইন্ডিকেটর ব্যবহার করে মার্কেট সেন্টিমেন্ট পরিমাপ করা যায়। বিনিয়োগকারীরা সাধারণত মার্কেট সেন্টিমেন্টকে বিয়ারিশ বা বুলিশ হিসেবে ভাগ করে থাকে। বুলিস মার্কেটে প্রায় সকল শেয়ারের মূল্য বাড়তে থাকে আর এর বিপরীতে বিয়ারিশ মার্কেটে প্রায় সকল শেয়ারের মূল্য কমতে থাকে।
চিত্রঃ DSEX সূচকের সাম্প্রতিক বুলিশ ও বিয়ারিশ মার্কেট সেন্টিমেন্ট
শেয়ারবাজার প্রায়শই বিনিয়োগকারীদের আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয় তাই এটিকে সবসময় মৌলিক বিষয় দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই শেয়ারবাজার থেকে সর্বাধিক রিটার্ন পাওয়ার জন্য মার্কেট সেন্টিমেন্টকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী ট্রেডিং বা বিনিয়োগ কৌশল গ্রহণ করা উচিত।
মার্কেট সেন্টিমেন্টের উপর ভিত্তি করে ট্রেডিং কৌশল
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা মার্কেট সেন্টিমেন্ট এনালাইসিসকে স্টক ট্রেডিংয়ের জন্য একটি প্রচলিত কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। বিনিয়োগকারীদের হার্ড বিহেভিয়ার (herd behavior) এর কারণে একরকম ফ্রি-রাইডার ইফেক্ট সৃষ্টি হয় যার ফলে বেশিরভাগ শেয়ারের মূল্য একই ট্রেন্ড অনুসরণ করতে থাকে। বিনিয়োগকারীদের এমন আচরণ স্বল্পমেয়াদে ভালো ফলাফল দিলেও দীর্ঘমেয়াদে কখনো এটি একটি ভাল বিনিয়োগ পরিকল্পনার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
স্বল্পমেয়াদে সাধারণত কোনো শেয়ারের মূল্য বর্তমানে যে দিকে যাচ্ছে সেদিকেই যেতে থাকে। তাই যেসব শেয়ারের মূল্য বর্তমানে আপট্রেন্ডে আছে তা স্বল্প সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট পর্যন্ত বাড়তে থাকে। এই জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ট্রেডিং কৌশলকে ট্রেন্ড-ফলোয়িং বা মোমেন্টাম ট্রেডিং বলা হয়। তবে কোন কিছুই চিরকাল একই ট্রেন্ডে থাকে না। মার্কেটে ট্রেডারদের সেন্টিমেন্ট সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকলে মার্কেট ট্রেন্ড কখন ঘুরে যেতে পারে সেই সম্পর্কে আগাম সিগন্যাল পাওয়া সম্ভব। তাই অন্যান্য ট্রেডিং কৌশলের পাশাপাশি মোমেন্টাম ট্রেডারদের জন্য মার্কেট সেন্টিমেন্ট এনালাইসিসও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
অন্যদিকে, শেয়ারবাজারে একটি ভ্যালু ইনভেস্টমেন্ট কৌশল রয়েছে যেখানে বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করেন যে স্বল্পমেয়াদে মূল্যের গতিবিধি একটি কোম্পানির মৌলিক অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা দিতে পারে না। কারণ শেয়ারবাজার প্রায়শই কোন ভালো বা খারাপ খবরের প্রতি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। ভ্যালু ইনভেস্টররা সেই সকল স্টকগুলোর সন্ধান করে যেগুলো বর্তমানে কোম্পানির অন্তর্নিহিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে লেনদেন হচ্ছে।
এমন অনেক বিনিয়োগকারীও আছেন যারা মার্কেটের প্রচলিত সেন্টিমেন্টের বিপরীতে গিয়ে তাদের ট্রেডিং কৌশল সাজান। মার্কেট এর চরম বৈরী সময়ে তারা বীট-ডাউন (beat-down) স্টকগুলোর সন্ধান করে যেগুলোর ফান্ডামেন্টাল খুব শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে খুবই কম মূল্যে বাজারে লেনদেন হচ্ছে।
মার্কেট সেন্টিমেন্ট মূলত বিনিয়োগকারীদের মনস্তাত্বিক অবস্থার একটি বহিঃপ্রকাশ। বুলিশ সেন্টিমেন্ট সাধারণত বিনিয়োগকারীদের লোভের মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত এবং বিয়ারিশ সেন্টিমেন্ট সাধারণত বিনিয়োগকারীদের ভীতিকর মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত। বিখ্যাত বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট বলেছেন, “যখন অন্যরা লোভ করছে তখন তুমি ভীত হও এবং যখন অন্যরা ভীত তখন তুমি লোভী হও”। তাই শেয়ারবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়ার জন্য ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল এনালাইসিসের পাশাপাশি মার্কেট সেন্টিমেন্টকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।