শেয়ারবাজার সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগের এক অন্যতম মাধ্যম। এটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টির জন্য খুবই কার্যকর একটি প্ল্যাটফর্ম। তবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে বিনিয়োগ করে যেমন প্রচুর অর্থ ও সম্পদ বৃদ্ধির সুযোগ আছে, তেমনিভাবে অপরিকল্পিত এবং কৌশলবিহীন বিনিয়োগের কারণে বিনিয়োগকৃত পুঁজি হারানোর সম্ভাবনাও প্রবল। দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য কার্যকর বিনিয়োগ কৌশল সম্পর্কে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বিনিয়োগকারীদেরকে শেয়ারবাজার সংক্রান্ত নানারকম তথ্য এবং সংবাদের বিশাল প্রবাহের মধ্যেও বিনিয়োগের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় মনযোগী থাকতে সাহায্য করে। আপনি যদি শেয়ারবাজারে নতুন হয়ে থাকেন অথবা বিনিয়োগের কৌশল সম্পর্কে অবগত না থাকেন তবে নিম্নলিখিত বিনিয়োগের কৌশলগুলো আপনাকে আপনার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু বিনিয়োগ কৌশলঃ
বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করুন
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করার জন্য প্রথম ধাপ হলো একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার আগে আপনার বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আপনার বয়স ও আর্থিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিন। বিনিয়োগ থেকে আপনি যে লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে চান এবং সেগুলো অর্জনের সম্ভাব্য সময়সীমা চূড়ান্ত করুন। কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন, কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন, কত সময়ের জন্য বিনিয়োগ করবেন এবং কী পরিমান মুনাফা অর্জন করার লক্ষ্য এসব সম্পর্কে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করুন। এরপর আপনার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য যথাযথ কৌশল অবলম্বন করুন।
দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যে মনোযোগ দিন
শেয়ারবাজার অদূরদর্শীদের জন্য নয়। এখানে সফল হবার সম্ভাবনা বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করার প্রবণতা রয়েছে যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত না নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এটি বিনিয়োগের ঝুঁকি কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যকরণ
আপনি যদি শেয়ারবাজারে নতুন হন তবে আপনার বিনিয়োগ করা অর্থের বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। শেয়ারবাজারে আপনার যাত্রা শুরু করার সাথে সাথে আপনার সমস্ত মূলধন একটি বা অল্প কিছু সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করবেন না। আপনার পোর্টফোলিওর সামগ্রিক ঝুঁকি কমানোর জন্য বিভিন্ন ধরণের আর্থিক সিকিউরিটিজ ও সম্পদে অর্থ বিনিয়োগ করুন যাতে একটি সিকিউরিটিজ এর নেগেটিভ পারফরম্যান্স আপনার পুরো পোর্টফোলিওকে প্রভাবিত না করে।
মার্জিন লোন এড়িয়ে চলুন
মার্জিন লোন নিয়ে ট্রেডিং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কারণ বিনিয়োগের লাভ বা ক্ষতি যাই হোক না কেন মার্জিন লোন সুদসহ ব্রোকারকে পরিশোধ করতেই হবে। মার্জিন লোনের সুদের চেয়ে বিনিয়োগের প্রকৃত রিটার্ণ যদি বেশি না হয় তাহলে বিনিয়োগকারী ক্ষতির মধ্যে পড়তে পারেন। অতএব শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মার্জিন লোন এড়িয়ে চলা উচিত।
প্রয়োজনে “স্টপ লস” ব্যবহার করুন
এই কৌশলটিতে যখন একটি স্টকের মূল্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে যায় তখন উক্ত স্টকটি বিক্রি করার জন্য ব্রোকারকে একটি অগ্রিম আদেশ দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আপনার বিনিয়োগের ক্ষতির মাত্রাকে সীমিত করতে পারেন।
লোভ ও ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করুন
লোভ ও ভয়ের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে শেয়ারবাজারে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। ক্রমবর্ধমান বা পতনশীল বাজারে স্টক ট্রেড করার সময় আপনার লোভ এবং ভয়ের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন এবং আপনার বিনিয়োগকৃত সিকিউরিটিজের মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে নজর দিন।
গুজব এবং হার্ড বিহেভিয়ার (herd behavior) থেকে এড়িয়ে চলুন
যেকোনো বিনিয়োগকারীদের জন্যেই গুজব এবং তথ্যের মধ্যে পার্থক্য করা গুরুত্বপূর্ণ। শেয়ারবাজারে যেকোনো তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেই তথ্যটি যতটা সম্ভব ক্রস-চেক করে যাচাই করুন। ব্রেকিং নিউজ বা মানুষের মতামতের উপর ভিত্তি করে কোনো কিছুর প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়বেন না এবং তাড়াহুড়া করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। শেয়ার ট্রেডিং এর ক্ষেত্রে কোন প্রকার গুজবের বশবর্তী না হয়ে বা অন্যের কার্যকলাপ দেখে প্রভাবিত না হয়ে স্টকের ফান্ডামেন্টাল এবং টেকনিকাল এনালাইসিস কে প্রাধান্য দিন।
পোর্টফোলিওর ভারসাম্য বজায় রাখতে একাউন্টে কিছু নগদ ব্যালেন্স রাখুন
আপনার বিও একাউন্টের সম্পূর্ণ টাকা একবারে বিনিয়োগ না করে কিছু অংশ আপনার পোর্টফলিও মিক্সকে রিব্যালেন্সিং করার জন্য রেখে দিতে পারেন। এতে করে মন্দা বাজারেও আপনার বিনিয়োগ সুরক্ষিত থাকতে পারে।
আইপিওতে বিনিয়োগ করুন
বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে যে মাধ্যম ব্যবহার করে সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে ভালো মুনাফা করতে পারেন সেটি হলো আইপিওতে বিনিয়োগ করা। আইপিওতে বিনিয়োগ নিরাপদ কারণ এটিতে বিনিয়োগ করলে স্বল্পমেয়াদে নিশ্চিত মুনাফা অর্জন করা যায় এবং বিনিয়োগের সামগ্রিক ঝুঁকি কিছুটা হ্রাস পায়। ঝুঁকি বিমুখ বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিনিয়োগ করা একটি নিরাপদ ও আকর্ষণীয় মাধ্যম।
আস্থা রাখুন দক্ষ পোর্টফোলিও ম্যানেজারের উপর
আমাদের শেয়ারবাজারে বেশ কিছু দক্ষ ও অভিজ্ঞ এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন একঝাঁক দক্ষ পোর্টফোলিও ম্যানেজার। শেয়ারবাজার সম্পর্কে যারা কম জানেন বা জ্ঞান আহরণের সুযোগ সীমিত, তারা নিজেরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত না নিয়ে পোর্টফোলিও ম্যানেজারের ওপর আস্থা রাখতে পারেন। অনেক পোর্টফোলিও ম্যানেজার আছেন যাদের হাতে আপনার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বাজারের যেকোনো বিকল্প বিনিয়োগের সুদহারের চেয়ে বেশি হারে মুনাফা পেতে পারেন। তাই না জেনে, না বুঝে যেখানে-সেখানে বিনিয়োগ করার বদলে দক্ষ পোর্টফোলিও ম্যানেজারের পরামর্শ নিন।
বিনিয়োগের এই সাধারণ কৌশলগুলো অবলম্বন করে শেয়ারবাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ অন্য যেকোনো বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ থেকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই গুজবের বশবর্তী না হয়ে শেয়ারবাজার সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে এবং যথাযথ কৌশল অবলম্বন করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিন।