মূল্যস্ফীতিঃ কি, কেন এবং এর প্রকারভেদ
মূল্যস্ফীতি বা ইনফ্লেশন হলো এমন একটি অর্থনীতির শব্দ যা আমরা হরহামেশাই ব্যবহার করে থাকি। অর্থনীতির এই সূচকটি সম্পর্কে অনেক পাঠকেরই ধারণা অস্পষ্ট। আজকের আলোচনায় আমরা মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে ধারণা লাভের চেষ্টা করব।
কি এই মূল্যস্ফীতি?
কোনো নির্দিষ্ট একটি সময়ে, কোনো একটি দেশের পণ্য ও সেবার মূল্যস্তরের সাধারণ বৃদ্ধিকে মূল্যস্ফীতি নামে অভিহিত করা হয়। এইরূপ মূল্যস্ফীতির দরুন কোনো একটি মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। যখন মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, তখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। মূল্যস্ফীতির দরুন একই পরিমাণ মুদ্রার বিনিময়ে পূর্বের চেয়ে কম পণ্য পাওয়া যাবে বা একই পরিমাণ পণ্য কিনতে পূর্বের চেয়ে বেশি মুদ্রার প্রয়োজন হবে।
বিশ্বের সকল দেশে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে একটি হল মূল্যস্ফীতি। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো দেশের মুদ্রার মানের কতটুকু অবমূল্যায়ন হলো তা জানার জন্য মূল্যস্ফীতি ব্যবহার করা হয়। পণ্য ক্রয় বা সেবা ভোগ করতে গিয়ে বিক্রেতা বা সেবা প্রদানকারীকে যে পরিমান অর্থ পরিশোধ করতে হয়, তাই হলো সেই অর্থের বা মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা। মূল্যস্ফীতির কারণে মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন হয়, ফলে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। এমন পরিস্থিতিতে সমপরিমাণ অর্থের বিনিময়ে পূর্বাপেক্ষা কম পণ্য বা সেবা ক্রয় করা যায়।
ক্রয়ক্ষমতা
মুদ্রার মূল্যের বহিঃপ্রকাশই হলো ক্রয়ক্ষমতা। উদাহরণস্বরূপ, মনে করুন, আগে একটি কলমের দাম ছিলো ৫ টাকা। তখন আপনি ১০ টাকায় দুটো কলম পেতেন। অর্থাৎ আপনার ১০ টাকার ক্রয়ক্ষমতা দুটো কলম। কিন্তু কোন কারণে একটি কলমের মূল্য বেড়ে ১০ টাকায় দাঁড়িয়ে যায় গেছে। এর ফলে এখন আপনার ১০ টাকার ক্রমক্ষমতা কমে এসেছে একটি কলমে। অর্থাৎ এখন ৫ টাকা ঐ একই কলমের অর্ধেক মূল্য মাত্র। মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে বলেই, পণ্যের মূল্য আগের চেয়ে বেশি হয়েছে।
ক্রয় ক্ষমতা কমার প্রধান করণগুলো হলো সরকারি রেগুলেশন, মূল্যস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।
মূল্যস্ফীতি কেন ঘটে?
মূল্যস্ফীতির কারণকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা যায়। মূল্যস্ফীতি মূলত তিনটি কারণে ঘটে থাকে। এগুলো হলো ডিমান্ড পুল (অত্যধিক চাহিদা), কস্ট পুশ (খরচের উর্ধমূখীতা) এবং সরকার নির্ধারিত মূল্য।
[table id=7 /]
ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশনের প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ –
- পণ্য বা সেবার অতিরিক্ত চাহিদা
- মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ এবং ঋণ প্রদান
- অর্থনীতি পূর্ণ ধারণক্ষমতায় পরিচালিত হলে (অর্থাৎ সর্বোচ্চ সরবরাহ সক্ষমতা ব্যবহার হয়ে যাওয়ায় সরবরাহ বাড়ানো আর সম্ভব নয়)
- কোনো একটি দেশের অর্থনীতির উৎপাদন পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা অপেক্ষা অধিক হলে যাকে অন্যথায় ধনাত্মক উৎপাদন গ্যাপ বলা হয় [ধনাত্মক উৎপাদন গ্যাপ = অ্যাকচুয়াল প্রোডাকশন > ফুল প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি]
কস্ট পুশ ইনফ্লেশনের প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ –
- শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধনশীল মজুরি খরচ
- ঊর্ধ্বগামী কাঁচামাল এবং উপাদান খরচ যা দেশি এবং বিদেশী সরবরাহকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়
- বিদেশী কারেন্সির (যেমন ডলার) বিপরীতে টাকার মূল্য কমে গেলে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পায় যা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করে দেয়
সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের বৃদ্ধিজনিত ইনফ্লেশন –
- নিয়ন্ত্রিত পণ্য বা সেবার মূল্যে পরিবর্তন (যেমন পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ইত্যাদি)
- করভার বৃদ্ধি; উদাহরণস্বরূপ – পরোক্ষ কর বৃদ্ধি (যেমন ভ্যাটের হার বৃদ্ধি) বা প্রচলিত ভর্তুকি তুলে নেয়া (যেমন সরকার সারের ভর্তুকি তুলে নিলে সারের দাম বৃদ্ধি পাবে যা কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দেবে)
মূল্যস্ফীতির প্রকারভেদ
দ্রুততার ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি চার প্রকার। এগুলো হলো মৃদু মূল্যস্ফীতি (ক্রিপিং), শক্তিশালী মূল্যস্ফীতি (ওয়াকিং), দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতি (গ্যালপিং) এবং অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি (হাইপারইনফ্লেশন) ।
১. মৃদু মূল্যস্ফীতি (ক্রিপিং)
বাৎসরিক মূল্যস্ফীতির পরিমান ৩% বা তার কম হলে তাকে মৃদু মূল্যস্ফীতি নামে অভিহিত করা হয়। মৃদু মূল্যস্ফীতির ফলে পণ্য বা সেবার মূল্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় যা বর্তমান চাহিদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মৃদু মূল্যস্ফীতির দরুন ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশায় ভোক্তাগন বর্তমানে কম মূল্যে ক্রয় করে থাকেন। যেহেতু মৃদু মূল্যস্ফীতি চাহিদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে, সেহেতু এটিকে অর্থনীতির জন্য ভালো হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানির মতো উন্নত দেশসমূহে মৃদু মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। এসকল দেশের প্রবৃদ্ধির হার উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় কম হয়ে থাকে। কারণ, এসকল দেশ ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিপক্কতা অর্জন করেছে। ফলস্বরূপ এসকল দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। এসকল দেশে জ্বালানি পণ্যের মূল্য ও মজুরি দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। ফলস্বরূপ উন্নত দেশগুলো মৃদু মূল্যস্ফীতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
২. শক্তিশালী মূল্যস্ফীতি (ওয়াকিং)
৩% থেকে ১০% পরিসরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি থেকে থাকলে তাকে শক্তিশালী মূল্যস্ফীতি বলে। এরূপ মূল্যস্ফীতির ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি দ্রুত হতে থাকে যা অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমতাবস্থায় দ্রুত ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশায় ভোক্তাগন প্রয়োজনের অধিক ক্রয় করতে থাকেন। এরূপ অত্যধিক চাহিদার দরুন পণ্য বা সেবার মূল্য আরো দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে পণ্য ও সেবার মূল্য আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে যার সাথে সর্বরাহকারীগণও ধীরে ধীরে তাল মিলাতে অপারগ হন। শ্রমবাজারের শ্রমজীবীগণের মজুরির বৃদ্ধিও এরূপ মূল্যস্ফীতির গতির সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় পণ্য বা সেবার মূল্য এতো বেশি বেড়ে যায় যে তা সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়। যেমনঃ বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শক্তিশালী মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। দেশের দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এসকল দেশের সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হয় যার অংশ হিসেবে এসকল দেশে শক্তিশালী মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়। দেশের ব্যবসায় এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে এসকল দেশ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের প্রচুর পরিমানে ঋণ প্রদান করে থাকে। এতে দেশের অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশে শক্তিশালী মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি তৈরী হয়। এসকল ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সদা সতর্ক থাকে।
৩. দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতি (গ্যালপিং)
যখন বাৎসরিক মূল্যস্ফীতির পরিমান ১০% বা এর অধিক হয়ে থাকে তখন থাকে দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতি নাম অভিহিত করা হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ভয়ানক অবস্থার মুখোমুখি হয়। মুদ্রার মান এতো দ্রুত কমতে থাকে যে ব্যবসায়ের আয় এবং শ্রমজীবগণের আয় এর সাথে তাল মিলাতে পারেনা। পণ্য বা সেবার মূল্য যে গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে সে গতিতে ব্যবসায় বা শ্রমজীবগণের আয় বৃদ্ধি পায় না। বিদেশী বিনিয়োগকারীগণ দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতির দেশেগুলোতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন যার ফলে দেশটি প্রয়োজনীয় মূলধন প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হয়। এক্ষেত্রে অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পরে এবং সরকার তার গ্রহণযোগ্যতা হারাতে থাকে। এরূপ পরিস্থিতি যেকোনো অবস্থায়ই ঠেকানো প্রয়োজন। যেমনঃ তুরস্ক, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, আর্জেন্টিনার মতো দেশসমূহ সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতির মধ্যে পতিত হয়। দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে অধিকাংশ সময়েই মুদ্রা ছাপানোর প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাকে দায়ী করা যায়। জাতীয় বাজেটের বিশাল ঘাটতি মেটাতে দেশগুলো মুদ্রা ছাপানোকেই সহজ এবং একমাত্র পন্থা হিসেবে বেঁচে নেয়। ফলশ্রুতিতে এসব দেশে পরবর্তীতে দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়।
৪. অত্যধিক মূল্যস্ফীতি (হাইপারইনফ্লেশন)
এই পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে পরে এবং মাসিক মূল্যস্ফীতির হয়ে দাঁড়ায় ৫০% এরও বেশি। সরকার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। এতে অর্থনীতিতে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যেমনঃ ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে জিম্বাবুয়েতে অত্যধিক মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জিম্বাবুয়ের সরকারের কৃষিজমি বাজেয়াপ্তকরণ এবং পুনর্বন্টন, বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রস্থান, খরা, অত্যধিক মাত্রায় মুদ্রা ছাপানো সহ আরো কিছু প্রতিকূল অর্থনৈতিক ফ্যাক্টর জিম্বাবুয়েকে অত্যধিক মূল্যস্ফীতির দেশে পরিণত করে।
প্রধান চার প্রকার মূল্যস্ফীতি ছাড়াও আরো কিছু প্রকার মূল্যস্ফীতি রয়েছে যেমন নিশ্চলতা-স্ফীতি (স্টেগফ্লেশন), মূল মূল্যস্ফীতি (কোর ইনফ্লেশন), মুদ্রা সংকোচন (ডিফ্লেশন) ইত্যাদি। এসব মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিচে দেয়া হলো।
নিশ্চলতা-স্ফীতি (স্টেগফ্লেশন)
যখন মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি থাকে কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকটা নিশ্চল হয়ে পরে এবং বেকারত্ব বাড়তে থাকে তখন মন্দা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যাকে স্টেগফ্লেশন নাম অভিহিত করা হয়। যেমনঃ ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল অনেক বেশি। ৬০ এর দশকে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি আবর্তিত ছিল বেকারত্ব কমানো এবং পণ্য বা সেবার ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধি নিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নীতি টেকসই ছিল না। ফলশ্রুতিতে আমেরিকায় ওয়েজ প্রাইস স্পাইরাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে মজুরি বৃদ্ধি এবং মূল্য বৃদ্ধির এক অবিরাম চক্রের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে পণ্য এবং সেবার মূল্য বৃদ্ধির দরুন শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পায় এবং শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির দরুন পণ্য এবং সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায়। এ চক্রটি ৭০ এর দশকে আমেরিকায় অনবরত চলতে থাকে. তাছাড়া জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহ কমে আসা জনিত কারণে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির সুযোগ কমে আসে। অতঃপর ধীরে ধীরে আমেরিকায় বেকারত্ব বাড়তে থাকে। এ পরিস্থিতিতে আমেরিকায় স্টেফ্লেশন এর সৃষ্টি হয়।
মূল মূল্যস্ফীতি (কোর ইনফ্লেশন)
মূল্যস্ফীতি পরিমাপের ক্ষেত্রে খাদ্য এবং এনার্জি সেক্টরের দ্রব্যসমূহ ব্যতীত সকল পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পরিমাপ করা হলে তাকে কোর ইনফ্লেশন বলে। খাদ্য এবং এনার্জি সেক্টরের দ্রব্যসমূহের দাম ঘন ঘন উঠানামা করে বিধায় তা মূল্যস্ফীতি পরিমাপে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। অতঃপর মূল মূল্যস্ফীতি পরিমাপের ক্ষেত্রে এসকল উদ্বায়ী পণ্যের মূল্য বাদ দেয়া হয়। যেমনঃ ২০১৭ থেকে শুরু করে এবং ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল মূল্যস্ফীতি ছিল নিন্মগামী এবং ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় হতে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল মূল্যস্ফীতি ছিল উর্দ্ধগামী। কিন্তু এ সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের মূল মূল্যস্ফীতি খাদ্য মূল্যস্ফীতি এবং সাধারণ মূল্যস্ফীতি অপেক্ষা অনেক কম ছিল। উপরে উল্লিখিত সময়কালের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল মূল মূল্যস্ফীতির বিপরীত পথগামী এবং সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল অনেকটা ফ্ল্যাট। কিন্তু ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে এসে বাংলাদেশের মূল মূল্যস্ফীতি, খাদ্য মূল্যস্ফীতি এবং সাধারণ মূল্যস্ফীতি একই বিন্দুতে মিলিত হয় এবং পরবর্তীতে একই প্রায় একইভাবে চলতে থাকে।
মূল্য সংকোচন (ডিফ্লেশন)
মূল্যস্ফীতির বিপরীত পরিস্থিতি হলো মূল্য সংকোচন। এ ধরণের পরিস্থিতিতে দ্রব্য ও সেবার মূল্য কমতে থাকে। মূল্যস্ফীতি ০% এর নিচে নেমে আসে। মুদ্রার মান দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ খরচ করতে অনাগ্রহী হয়ে পরে এই ভেবে যে পণ্যের বা সেবার মূল্য ভবিষ্যতে কমে আসবে। এতে করে দিন দিন মুদ্রা সংকোচন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং এতে অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হতে পারে। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাপানে অর্থনৈতিক নিশ্চলতা এবং মূল্য সংকোচন পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। এ সমকালকে জাপানের লস্ট ডিকেড নামে অভিহিত করা হয়। এ সময়কালের মধ্যে জাপান ক্রেডিট ক্রাঞ্চ এবং লিকুইডিটি ট্র্যাপ উভয় সংকটের মুখোমুখি হয়। এরূপ মূল্য সংকোচন পরিস্থিতির ফলে জাপানের নমিনাল জিডিপি ১৯৯৫ সালে ৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলার হতে ২০০৫ সালে ৪.৮ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
[table id=8 /]
কেবল পণ্যের মূল্য বাড়লেই কি তাকে মূল্যস্ফীতি বলা হবে?
কেবল পণ্যের মূল্য বাড়লেই তাকে মূল্যস্ফীতি বলা যাবে না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একটি দেশের সামগ্রিক মূল্যস্তরের বৃদ্ধিই হলো মূল্যস্ফীতি। হরহামেশাই দেশের বিশেষ কিছু পণ্যের দামে ওঠানামা হয়। কিন্তু এর জন্য দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মুদ্রার মূল্য কমে যাওয়ার ঘটনা ঘটে না। মূল্যস্ফীতি একটি দেশের গোটা অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়। এটি বুঝতে আমাদের মূল্যস্ফীতির পরিমাপের সূচক সম্পর্কে জানতে হবে। ‘মূল্যস্ফীতি সূচক’ ব্যবহার করে একটি দেশের মূল্যস্ফীতির হার পরিমাপ করা হয়।
এর পরের আলোচনায় আমরা মুল্যস্ফীতির পরিমাপ পদ্ধতি, এর কাম্যতা এবং সার্বিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব। এছাড়াও আমরা নানা দেশে মূল্যস্ফীতির অবস্থা নিয়ে জানার চেষ্টা করবো।