
পি/ই রেশিও কি? কিভাবে এটা কোম্পানী কে প্রভাবিত করে?
শেয়ার বাজার সংক্রান্ত যেকোনো কাজে জড়িত বা আগ্রহী, কিংবা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন এমন কেউ যখন বলেন তিনি P/E Ratio কি জানেন না বা এর নাম শোনেন নি, তখন এটি অবিশ্বাস্যই লাগে। বিভিন্ন সময়ে শেয়ার বাজারের দরপতন আর ধস বিনিয়গোকারীদের আগের থেকে অনেক বেশী সচেতন আর শিক্ষিত করে তুলেছে। তবে এই শিক্ষাতেও আছে শুভঙ্করের ফাঁকি।
ট্রেড আওয়ার ব্যাতীত একজন বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বেশী সময় প্রথমে দেয়া উচিৎ বিভিন্ন কোম্পানির প্রান্তিক প্রতিবেদন, কোম্পানির এনালাইসিস অথবা নতুন নতুন টেকনিক আয়ত্ব করা। কিন্ত অধিকাংশ বিনিয়োগকারী, এসব ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন। শেয়ার বাজারের একদম ব্যাসিক কিছু বিষয়ে ধারনা না থাকায় ছোটো ছোটো ভুলের দরুন বড় ধরনের খেসারত দিতে হয় হরহামেশাই।
পি/ই রেশিও সেরকম কিছু ব্যাসিক জানাশোনার মধ্যে একটি। কোন কোম্পানীর স্টক কিনলে কতো সময়ের মধ্যে বিনিয়োগকারী লাভ করতে পারবে। বা নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ ওই কোম্পানীর শেয়ার থেকে আয় করতে কতো সময় লাগতে পারে সেটার ধারনা পাওয়ার জন্য পি/ই রেশিও জানা জরুরী। আমরা পি/ই রেশিওর আদ্যোপান্ত ও কোম্পানীর শেয়ার এর উপর এই রেশিওর ভূমিকার আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলবো।
পি/ই রেশিও কি?
পি/ই রেশিও বা প্রাইস আর্নিং রেশিও এর আক্ষরিক অর্থ করলে দাঁড়ায় “উপার্জনের মূল্য অনুপাত”। ব্যাবহারিক অর্থে এটাকে “লাভের গুনিতক” বলা যায়। এবার আসা যাক কি এই P/E ratio?
শেয়ার বাজারে প্রতিটি শেয়ারের মূল্য এবং প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে কোনো কোম্পানী কি পরিমান আয় করে থাকে তার অনুপাতকে Price Earning Ratio বা পি/ই রেশিও বলা হয়। পি/ই রেশিও দ্বারা স্টক এর মুল্যের মান নির্ণ্যয় করা যেতে পারে৷
প্রাইস আর্নিং রেশিও দ্বারা একটা স্টক কেনার পরে সেই স্টক এর মূল্য ফেরত পেতে কতো সময় লাগতে পারে সেটার একটা হিসাব পাওয়া সম্ভব। একটি কোম্পানীর বিগত ও ভবিষ্যত এর আয় এর উপর নির্ভর করে আপনার স্টক এর মুল্য ফেরতের সময় কাল নির্ধারণ করে দিবে এই পি /ই রেশিও।
পি/ই রেশিও কিভাবে হিসাব করে?
খুব সহজেই একজন বিনিয়োগকারী একটা স্টক এর প্রাইস আর্নিং রেশিও বের করে ফেলতে পারে। একটা স্টক এর বর্তমান বাজার মুল্য কে ওই কোম্পানীর শেয়ার প্রতি আয় দিয়ে ভাগ করলে খুব সহজেই পি/ই রেশিও বের হয়ে আসে।
Price Earnings Ratio:
P/E= Price of Stock (শেয়ার এর মূল্য) ÷ EPS (শেয়ার প্রতি আয়)
একটা কোম্পানীর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বা শেয়ার মার্কেটের এনলিস্টেড কোম্পানীর ড্যাশবোর্ডে একটা স্টক এর বর্তমান বাজার মূল্য পাওয়া যায়।
পি/ই রেশিও যতো কম হয়, বিনিয়োগ ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়। পি/ই রেশিওর একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারেঃ
ধরা যাক একটা কোম্পানির শেয়ার এর বর্তমান বাজার মূল্য ৪৫ ডলার। আর সেখান থেকে কোম্পানীর বাৎসরিক শেয়ার প্রতি আয় যদি ৫ ডলার হয় তাহলে ওই কোম্পানির পি/ই রেশিও হবে ৯ ডলার। এর অর্থ হচ্ছে যদি কোম্পানিটি তার বাৎসরিক আয়ের পুরোটা শেয়ারের লভ্যাংশ হিসেবে বিতরন করে দেয় তবে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে ৯ বছর সময় লাগবে।
এখানে শেয়ারের বাজার মূল্য যদি ৭৫ ডলার হোতো সেক্ষেত্রে পি/ই রেশিও হোতো ১৫। অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে সময় লাগবে ১৫ বছর, যদি সেই কোম্পানিটির আয়ের ধারা অক্ষুন্ন থাকে।
পি/ই রেশিও কোম্পানিকে কিভাবে প্রভাবিত করে?
একটি কোম্পানির স্টক বা শেয়ার এর বিক্রি কতো টুকু হবে সেটা নির্ভর করে বিনিয়োগকারীরা সেই কোম্পানীর ওপর কতটুকু ভরসা করে। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে কতো বছর সময় লাগতে পারে সেটার উপর নির্ভর করে শেয়ার বাজারে স্টক ক্রয় বিক্রয় হয়ে থাকে। একদমই নির্বোধ বিনিয়োগকারী ব্যাতীত, কোনো কোম্পানীর স্টক কেনার আগে নূন্যতম এটুক হিসাব খতিয়ে দেখে। পি/ই রেশিও ই নির্ধারণ করে দেয় যে কতো দ্রুত একজন তার বিনিয়োগ কৃত অর্থ হতে লভ্যাংশ পেতে পারে।
শেয়ারের মুল্য ও আয়ের অনুপাত যতো কম হবে বিনিয়োগে ঝুঁকির পরিমান ততো কম হবে। অনুপাত বেশী হলে স্বভাবতই বিনিয়োগ কৃত অর্থ ফেরত এর দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়। এবার দেখা যাক কিভাবে স্টক মার্কেটে কোম্পানির উপর এই পি/ই রেশিও প্রভাব ফেলে।
কম পি/ই রেশিওঃ
যে স্টক গুলোর PE কম হয়, ধরে নিতে হবে সেসব স্টক এর বাজার মূল্যও কম হয় এবং ভবিষ্যতে সেটার দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে। এসব কোম্পানী কে আন্ডারভ্যাল্যুড কোম্পানী বলা যেতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, শুধু মাত্র পি/ই রেশিও কম বলেই কি তার দাম বৃদ্ধি হবে? ঠিক তা নয়। পি/ই রেশিও কম এমন কোম্পানীর ক্ষেত্রে যদি ফান্ডামেন্টাল আর্নিংস গুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয় তবেই এই ক্ষেত্রে সফল হবার চান্স থাকে।
বেশী পি/ই রেশিওঃ
যেসব কোম্পানীর প্রাইস আর্নিং রেশিও বেশী থাকে সেসব কোম্পানীর শেয়ার কে বর্ধনশীল স্টকস বলা যেতে পারে। এটা কোম্পানীর ভবিষ্যত কার্যকারীতার দিকে ইংগিত করে। বিনিয়োগ কারী দের এসব কোম্পানীর দিকে বেশী নজর থাকে একই সাথে তারা বেশী আশাবাদী থাকে। একটা কোম্পানীর শেয়ার কতোগুলো বিক্রি হবে সেটার অনেক টাই হাইয়ার পি/ই রেশিও বোঝাতে সক্ষম।
আবার একই সাথে হাইয়ার পি/ই রেশিও যে বিনিয়োগ কারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সেটাও ইংগিত করে। প্রথমত, বেশী প্রাইস আর্নিং রেশিও সম্বলিত কোম্পানীর স্টক এর বর্তমান বাজার মূল্য বেশী থাকে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ কারীকে অনেক বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয় তার অর্থ ফেরত পেতে।
এমতাবস্থায়, কোম্পানিটি যদি তার আয়ের ধারাবাহিকতা বজায় না রাখতে পারে বা কোনো কারনে ক্ষতির সম্মুখীন হয় তবে বিনিয়োগকারী দের বিনিয়োগকৃত অর্থ পুরোটাই ঝুঁকির মুখে পরে যায়।
শেয়ার বাজারে সবসময় এরকম একটা নীতি শোনা যায়,”পি/রেশিও দেখে শেয়ার কিনুন। P/E ratio যতো কম হবে ততোই নিরাপদ। P/E রেশিও ১৫-২০ এর উপরে গেলেই বিপদ।” কিন্ত আসলেই কি তাই? বর্তমানে এই চিন্তাধারা থেকে বের না হয়ে আসার দরুন বহু বিনিয়োগকারী অল্প সময়ে মাথায় হাত দিয়ে বসছেন।
পি/ই রেশিও নির্ধারন করে কোন বিষয়গুলো?
আমরা একটা কথা শুনে থাকি, “জিনিস যেটা ভালো দাম তার একটু বেশিই” এই কথা টা পুরোনো হলেও বর্তমান শেয়ার বাজারের জন্য এই কথাটা হারে হারে সত্য। শেয়ার বাজারে বর্তমানে অনেক কোম্পানীই আছে যাদের শেয়ার মূল্য অনেক বেশী ঠিক একই সাথে তারা ফান্ডামেন্টালি অনেক ভালো। কিন্ত শুধু বেশী দাম বিধায় বিনিয়োগকারীরা এসব কোম্পানি কে এড়িয়ে চলে।
পি/ ই রেশিও এর পাশাপাশি একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনাকে আরোও জানতে হবে এর পিছনে আর কি কি বিষয় কাজ করে। পি/ই রেশিও কে নির্ধারণ করে দেয় কারা?
Growth Stock
এই টার্ম টার সাথে অনেকেই পরিচিত। দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগে সর্বাধিক মুনাফার জন্য এরকম কোম্পানী আদর্শ। যেসব কোম্পানী growth stock বিক্রি করে তাদের বাজার মূল্য বেশী হয় তাই পি/ই রেশিও বেশী থাকে। এসব কোম্পানীতে পি/ই অনুপাত এর আলোকে বিনিয়োগ যদিওবা ঝুঁকিপূর্ন মনে হয় কিন্ত এসব কোম্পানীতে সময় নিয়ে ইনভেস্ট করলে অধিক মুনাফা পাওয়া সম্ভব।
ডিভিডেন্ট রেশিও
যেসকল কোম্পানী বেশী বিনিয়োগকারীদের নগদ ডিভিডেন্ট প্রদান করে সেসব কোম্পানীর শেয়ার মূল্য বেড়ে যায় যার দরুণ P/E ratio ও বেড়ে যায়। যে কোম্পানী বিনিয়োগকারীদের বেশী ডিভিডেন্ট প্রদান করে তাদের বাৎসরিক ইনকাম কম থাকে সে হিসেবে তাদের শেয়ার বিক্রি কম হবার কথা। কিন্ত মানুষজন ক্যাশ ডিভিডেণ্ট এর প্রতি আগ্রহী হয়। ক্যাশ টাকা পাওয়ার চিন্তায় তারা বেশী মূল্য দিয়ে শেয়ার কিনতে পিছ পা হয় না। যার দরুণ, সেই কোম্পানীর পি/ই বেড়ে যায়।
ভয় এবং লোভ
শেয়ার এর মূল্য সব সময় বিনিয়োগকারীদের ব্যাবহারিক আচারনের উপর নির্ভর করে এমন নয়। একটা কোম্পানীর স্টক এর দরপতন বা উর্ধমূল্য অনেক সময় ভয় আর লোভ এর কারনেও হয়ে থাকে। এমন হয় যে হঠাৎ করে শেয়ারের মুল্য বেড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় লোভে পড়ে বিনিয়োগকারীরা অতি উচ্চ মুল্যেও স্টক ক্রয় করেন। আবার হঠাৎ শোনা গেলো, কোনো এক নির্দিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের দর পতন হয়েছে। প্যানিক অথবা ভয়ে কিছু না বুঝেই অনেকে স্বল্প মুল্যে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। অপরদিকে, সেই কোম্পানির আর্নিংস কিন্ত ঠিক আগের মতোই থাকে। শেষমেশ দেখা যায়, P/E রেশিও অনেক বেড়ে গিয়েছে বা কমে গিয়েছে।
কোম্পানীর ঋণ
কোনো কোম্পানীর স্টক এর পি/ই রেশিও কম অর্থই সেটি বেশী লাভজনক বা ঝুঁকি কম এমন কথার বিপরীতে আরেকটি উদাহরণ টানা যায় একটি ঋণগ্রস্থ কোম্পানী কে দিয়ে। একটি কোম্পানী যখন দেনাগ্রস্থ হয় তখন কোম্পানিটির শেয়ার কেনা বিনিয়োগকারীরা স্বভাবতই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বা ভয়ে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ফলশ্রুতিতে, এটা কোম্পানীর ভবিষ্যত আর্নিং এ খারাপ প্রভাব পরে এবং পরবর্তীতে সেই শেয়ার গুলোর P/E Ratio কমে যায়।
ম্যাক্রো কন্ডিশান্স
কিছু ইন্টারেস্টিং কন্ডিশান্স আছে শেয়ার বাজারে যেগুলো একটা কোম্পানীর শেয়ারের পি/ই রেশিও অদ্ভুদভাবে কমায় বা বাড়ায়। ধরা যাক একটা প্রান্তিক জায়গায় অবস্থিত মানুষের ইনকাম বাড়ছে তখন হুইলার বা ট্রাক্টর বিক্রি করে এমন কোম্পানির পি/ই রেশিও বাড়তে থাকে। আবার দেখা যায় একই সময়ে যখন শহরে যখন ভারী যন্ত্র বা অন্যান্য সরঞ্জাম এর চাহিদা বাড়ছে উৎপাদন বাড়সে পি/ই রেশিও কমে যাচ্ছে।
শেষ কথা
ওয়ারেন বাফেট এর উক্তি আছে, ” সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, তুমি কি করছো যখন সেটা তুমি জানো না”। শুধুমাত্র সঞ্চয় আর বিনিয়োগের সক্ষমতা আপনাকে সফল বিনিয়োগকারী বানায় না। স্মার্ট আর সচেতন না হলে আপনাকে “অল্প বিদ্যা ভয়ংকরীর” ভাগ্য বরন করতে হতে পারে।
শুধু মাত্র পি/ই রেশিও কম এটা যেমন লাভজনক বিনিয়োগের একমাত্র শর্ত হতে পারে না আবার কোনো স্টকের পি/ই রেশিও বেশী বিধায় সেটি আপনার জন্য ঝুঁকি বয়ে আনবে এমন টা ভাবাও বোকামী। পি/ই রেশিওর পেছনে কোম্পানী আর বাকী ফান্ডামেন্টাল বিষয়াদি সম্পর্কে সম্মক ধারনা আপনাকে সফল বিনিয়োগকারী হবার পথে অনেকটা এগিয়ে নিতে পারে।