স্বাবলম্বীর পথ চলাঃ পুঁজিবাজারে এক নারীর স্বপ্নময় অভিযাত্রা
By admin
স্বাবলম্বীর পথ চলাঃ পুঁজিবাজারে এক নারীর স্বপ্নময় অভিযাত্রা
স্বাবলম্বীর পথ চলাঃ পুঁজিবাজারে এক নারীর স্বপ্নময় অভিযাত্রা
নারীরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। তাদের দক্ষতা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে। কয়েক দশক আগে নারীদের মেধা, মতামতের তেমন কোনো মূল্যায়ন ছিল না। কিন্তু এখন ঘরে-বাইরে সব ক্ষেত্রেই নারীদের পদচারনা বিরাজমান।
জীবনের শুরুঃ
আন্নি একজন প্রাণবন্ত এবং দৃঢ়চেতা নারী। যার অবিচল সংকল্প ও সাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে সাফল্যের পথে নিয়ে গিয়েছে। অল্প বয়স থেকেই আন্নির সহজাত কৌতূহল ও জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ ছিল।
আন্নি শহরের এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠে। তার বাবা-মা উভয়ই পরিশ্রমী এবং অধ্যবসায়ের মূল্য ও স্বপ্নবিলাসী হওয়ার পাশাপাশি তাকে সঞ্চয় করার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। সেই স্বপ্নের মাঝে বেড়ে ওঠা আন্নির পারিবারিক শিক্ষার প্রতিফলিত হয়েছে।
শুরুতে আন্নি নিজের হাত খরচের যোগান দিতে টিউশন শুরু করেন। টিউশনির টাকা থেকে আন্নি কিছু টাকা সঞ্চয় করতে শুরু করে। পড়াশোনা শেষ করার পর তার একটি বেসরকারী স্কুলে অল্প বেতনের চাকরী হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় সামাজিক কারণে তাড়াতাড়িই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের বছর খানেক পার হওয়ার পরে আন্নি প্রথমবারের মত মা হয়। প্রথম বাচ্চার জন্মের পরে স্কুলের চাকরির পাশাপাশি ছেলের দেখাশোনা করা, স্বামী-সংসার সামলানো সব মিলিয়ে আন্নি খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। বছর দুয়েক পর আন্নির দ্বিতীয় বাচ্চার জন্ম হয়। সংসার বৃদ্ধির পর থেকে সংসারের খরচ তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে, এবং সঞ্চয়ের পরিমাণও কমতে শুরু করে। আন্নির সামান্য বেতন এবং তার স্বামীর বেতন মিলিয়ে এই সীমিত অর্থ দিয়ে অসুস্থ শ্বশুর-শ্বাশুড়ির চিকিৎসা, বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ, এবং সংসারের যাবতীয় খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিল পরিবারটি।
এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাভাবের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও এর প্রভাব বিস্তার করে। যে কারণে সীমিত উপার্জনের উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোতে আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। আন্নির পরিবারও এর বাইরে নয়। আন্নির স্বপ্ন সে তার বাচ্চাদেরকে উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তুলবে। নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াবে। এ জন্য তার বেশ অর্থের প্রয়োজন পরবে ভবিষ্যতে।
আন্নি বুঝতে পারছিল যে, সংসার চালানোর পাশাপাশি এই সীমিত অর্থ এবং সঞ্চয় দিয়ে তার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম। আন্নি প্রথমে ভাবল যে, কিছু পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন যা তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করবে, পাশাপাশি সে এটাও চিন্তা করল যে তিনি বাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবেন। কিন্তু ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ব্যবসা করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না এবং কোচিং করানো সম্ভব হচ্ছিল না সময়ের অভাবে। তথাপি সে অন্য উপায়ে স্বাধীনভাবে কিছু করার চিন্তা করতে থাকেন যাতে তিনি সংসার সামলানোর পাশাপাশি পরিবারে আর্থিকভাবে আরও অবদান রাখতে পারে। এছাড়া বাচ্চাদেরকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এবং নিজেকেও স্বাবলম্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
স্বপ্নের সোপানে প্রথম ধাপ – বিনিয়োগের জ্ঞানার্জনের হাতেখড়িঃ
চাকরী এবং মাসের হাতখরচ থেকে জমানো কিছু টাকা ছিল আন্নির হাতে, তা দিয়ে কি করা যায় সে পরামর্শ নিতে তিনি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গেলেন। যাওয়ার পর তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিকট জানতে চাইলেন যে, কোন স্কিম বা পলিসি করলে তার জন্য সুবিধাজনক হবে। কর্মকর্তা তাকে বিভিন্ন স্কিম, ডিপোজিট, এফডিআর সম্পর্কে অবগত করেন। আন্নি আরো কয়েক জায়গায় খোঁজ নিলেন, সেখানেও তাকে সামান্য পরিমাণ সুদ বা মুনাফার কথা বলে। সে তার পরিবারের সাথে কথা বলে বুঝলো যে দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির বিপরীতে এই সামান্য আয় দিয়ে তিনি উপকৃত হবেন না।
দিশাহীন আন্নির হঠাৎ তার কলেজ জীবনের বান্ধবী তানির কথা মনে পড়ে । আন্নি জানত যে তানি ক্যাপিটাল মার্কেট সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তানির সাথে দেখা করা ও পরামর্শ নেওয়ার জন্য আন্নি তার সাথে যোগাযোগ করে। তানির সাথে গল্পের ছলে আন্নি তার সমস্যার কথা তুলে ধরে এবং তানি তাকে তার অফিসে আসতে বলে। তানি তাকে পুঁজিবাজার সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং জানায়, তানি যে অফিসে কর্মরত, রয়্যাল ক্যাপিটাল লিমিটেড, সেখানে প্রায়ই ফ্রি ট্রেইনিং, ওয়ার্কশপ, সেমিনার আয়োজন করা হয় যা কিনা নতুন বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের জ্ঞান অর্জনে ভীষণ উপকারী। তানি তাকে পরামর্শ দেয় সেমিনারে অংশগ্রহণ করার জন্য এবং তার সহকর্মী দীপার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন যে কিনা একজন দক্ষ বিনিয়োগকারী। পরবর্তীতে দীপা, আন্নির সাথে কথা বলে এবং তাকে বিনিয়োগের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা দেয়। তিনি স্টক নির্বাচন, বিনিয়োগের সঠিক সময় নির্ধারণ, ঝুঁকি এবং আয়ের সামঞ্জস্যতা এইসকল দিকগুলো তুলে ধরেন।
স্বপ্ন পূরনের সারথি – বিনিয়োগের যাত্রা শুরুঃ
আন্নি তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আলোচনা করে বুঝলেন যে, শেয়ার-বাজারে বিনিয়োগ অর্থ উপার্জনের ভাল একটি উপায় হতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্রোকারেজ হাউজ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যার দ্বারা শেয়ার লেনদেন ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত শিক্ষার্জন তার জন্য সহজ হবে ।
আন্নি প্রথমে তার বান্ধবী তানি এবং দীপার পরামর্শে নেওয়ার পরে যাচাই-বাছাই করে রয়্যাল ক্যাপিটাল লিমিটেডকে নির্বাচন করল যার আর্থিক অবস্থা, ব্যবসায়িক মডেল, সমসাময়িক অন্যান্য ব্রোকারেজের তুলনায় সেবার মান ভালো অবস্থানে আছে।
আন্নি রয়্যাল ক্যাপিটাল লিমিটেডে নিজের নামে একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলেন এবং নিজের ক্ষুদ্র সঞ্চয় নিয়ে বিনিয়োগ শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ধারণা পেলেন যে, বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করলে সেটা তার পোর্টফলিওকে বৈচিত্র্যময় করে তুলবে যা তার ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করবে। যদি একটি সেক্টর আশানুরূপ মুনাফা না করে, তাহলে অন্য সেক্টর ভাল পারফর্ম করে পোর্টফোলিওতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রথমে অল্প পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেন আন্নি।
এছাড়া তিনি নিজেও অ্যাপ্সের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের লেনদেন এবং পোর্টাল থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। প্রথমদিকেই তার কিছু বিনিয়োগ আশানুরূপ সাফল্য লাভ করে। এই সাফল্য তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং তিনি আরও বিনিয়োগ করার প্রস্তুতি নেন। তার জ্ঞান, ধৈর্য এবং সাহসিকতা তাকে সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। তিনি এর মাঝে সামান্য আর্থিক ক্ষতিরও ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
স্বপ্ন হলো সত্যি–উন্নতি ও সাফল্যের পথে জয়যাত্রাঃ
সময়ের সাথে সাথে আন্নি একজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী হয়ে উঠেন। তার সাফল্য তাকে আরও বেশী বিনিয়োগের দিকে অগ্রসর করে এবং কাঙ্খিত আয়-উপার্জনে সক্ষম করে তোলে। তিনি একজন সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন এবং এই সাফল্য তার আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে উন্নত ও মজবুত করে। তার আর্থিক স্বাধীনতা, তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের জন্য একটি আদর্শ উদাহরণ স্থাপন করে, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাকে সুদৃঢ় করে এবং সমাজে তাকে একটি সাফল্যের স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
আন্নির ক্যাপিটাল মার্কেটে বিনিয়োগের মাধ্যমে সফল হওয়ার প্রতিটি ধাপে ছিল স্বপ্ন, উদ্দীপনা, অনুশীলন, প্রশিক্ষণ, সাহসিকতা, ধৈর্য এবং প্রস্তুতি। এই নারীর উত্থানের পথ মসৃণ ছিল না। কিন্তু তার জ্ঞান, দক্ষতা এবং আগ্রহ তাকে একজন সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিণত করে যার মাধ্যমে আন্নি তার স্বপ্ন – আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করেন।