কোম্পানি এনালাইসিস
কোম্পানি এনালাইসিস কী?
কোম্পানি এনালাইসিস হলো একটি কোম্পানির প্রোফাইল, পরিচালনাপর্ষদ, পণ্য এবং পরিষেবা, কার্যক্ষমতা, আর্থিক অবস্থা, লাভজনকতা, ঝুঁকিপ্রবণতা এবং সিকিউরিটিজ মূল্যায়নের সাথে সম্পর্কিত বিশ্লেষণ। এটিকে ‘ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস’ ও বলা হয়ে থাকে। কোম্পানি এনালাইসিসের জন্য একজন এনালিস্ট বা বিশ্লেষক কোম্পানির ইতিহাস এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনাগুলোকে বিবেচনা করে থাকেন। দীর্ঘমেয়াদী সম্পদ সৃষ্টির জন্য একজন বিনিয়োগকারী যে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন তা সম্পর্কে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কোম্পানি এনালাইসিস কেন প্রয়োজন?
বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ও সফল বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট (Warren Buffett) এর একটি উক্তি হলোঃ “Risk comes from not knowing what you’re doing”, অর্থাৎ “সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, তুমি কি করছো সেটা না জানা”।
কোনো শেয়ারে বিনিয়োগের ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস করার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কোম্পানি এনালাইসিস। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার আগে একটি কোম্পানিকে কিভাবে বিশ্লেষন করে কোম্পানিটি বিনিয়োগযোগ্য কিনা তা বের করতে হয় সেই সম্পর্কে আমাদের বিস্তারিত ধারণা থাকতে হবে। যারা ভালো কোম্পানি বাছাইয়ে দক্ষ, মার্কেটে মন্দা অবস্থা থাকলেও সেটি তাদের বিনিয়োগের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না। বরং মন্দা বাজারেও তারা মুনাফা করতে পারেন। আমাদের দেশে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই পুঁজিবাজার বিশ্লেষণ সম্পর্কে ধারণা কম থাকায় নানাধরনের গুজবে কান দেন এবং যাচাই বাছাই না করেই অন্যের দেয়া তথ্যের উপর নির্ভরশীল হন। যার ফলে একসময় তাদের সর্বস্বান্ত হয়ে পুঁজিবাজার ত্যাগ করতে হয় এবং বাজার সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়ে যায়। তাই পুঁজিবাজারে সফল হতে হলে কোম্পানি এনালাইসিসের সঠিক উপায় জানতে হবে।
কোম্পানি এনালাইসিসের ক্ষেত্রে যা বিবেচনা করতে হবে:
- কোম্পানির প্রোফাইল: কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগর সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সেই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও লক্ষ্য, উৎপাদিত পণ্য বা সেবা গ্রহীতার আকার, মুনাফার ধারাবাহিকতা, ভবিষ্যতে মার্কেট বড় হওয়ার সম্ভাবনা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকতে হবে।
- পণ্য বা পরিষেবা: কোম্পানিটি কি ধরনের পণ্য উৎপাদন করে বা কি ধরণের পরিষেবা প্রদান করে থাকে এবং সেই সকল পণ্য বা পরিষেবার বর্তমান ও ভবিষ্যত বাজার চাহিদা সম্পর্কে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। বিনিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য বা পরিষেবার মার্কেট শেয়ার বর্তমানে কত শতাংশ এবং ভবিষ্যতে মার্কেট শেয়ার কতটা পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা আছে সেটিও বিবেচনায় আনতে হবে।
- প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা: ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে এমন একটি শিল্পখাত থেকে কোন কোম্পানি নির্বাচন করা উচিত যার প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কোম্পানির আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করে এর সাথে প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোর বিগত কয়েক বছরের আর্থিক অবস্থার তুলনা করে বাজারে কোম্পানিটির বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তার সাথে এটিও দেখতে হবে যে কোম্পানিটির এমন কোন বৈশিষ্ট্য আছে কিনা যা এটিকে অন্য প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো থেকে আলাদা করতে পারে।
- ব্যবস্থাপনার মান: একটি কোম্পানির বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনার মান আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যবস্থাপনায় একটি প্রচলিত কথা রয়েছে, “একটি ভালো কোম্পানি বা খারাপ কোম্পানি বলতে কিছু নেই, রয়েছে কেবল ভালো বা খারাপ ব্যবস্থাপক”। সাধারণত একটি কোম্পানির প্রধান ব্যবস্থাপকরাই কোম্পানির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জন্য দায়ী থাকেন। তাই সর্বোপরি কোম্পানির পরিচালক বৃন্দের অবস্থা, তাদের ব্যবসায়ীক দূরদর্শিতা, পরিচালকবৃন্দের মধ্যে কোন মতানৈক্য আছে কিনা এবং, তাদের শেয়ার ধারণের পরিমান যথাযথ আছে কিনা তা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
- আর্থিক শক্তি: একটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থা যাচাই করা কোম্পানি এনালাইসিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একজন বিনিয়োগকারীকে অবশ্যই বিনিয়োগের আগে কোম্পানিটির আর্থিক বিবরণী যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। কোম্পানিকে বিনিয়োগকারীদের নিকট আকর্ষণীয় দেখানোর জন্য প্রকৃত আর্থিক বিবরণীর তুলনায় কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে কিছুটা বাড়িয়ে লেখা হতে পারে। তাই কোম্পানি এনালাইসিসের সময় একজন বিনিয়োগকারীকে সেই কোম্পানিটির বার্ষিক প্রতিবেদন সতর্কতার সাথে বিবেচনায় নিতে হবে।
- লভ্যাংশ বণ্টন পদ্ধতি: নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদান একটি কোম্পানির স্থিতিশীলতার নির্দেশক। সাধারণত বিগত ৫ বছরের লভ্যাংশের হার পর্যবেক্ষণ করলেই কোম্পানির অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। কোম্পানি তার পূর্ববর্তী বৎসর গুলোতে কি পরিমান লাভ করেছে এবং শেয়ারহোল্ডারদেরকে নিয়মিত নগদ লভ্যাংশ প্রদান করছে কিনা তা দেখতে হবে। সেই সাথে পে-আউট রেশিও অর্থাৎ কোম্পানিটি তার মোট আয়ের কত শতাংশ শেয়ারহোল্ডারদের বাৎসরিক ডিভিডেন্ট হিসেবে দেয় সেটিও বিবেচনা করতে হবে।
- প্রবৃদ্ধি এবং ঝুঁকি বিশ্লেষণ: শেয়ারের মূল্য কোম্পানির আয়ের উপর নির্ভর করে। তাই শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি পাবে কিনা তা আগে থেকেই অনুমান করার জন্য কোম্পানিটির ভবিষ্যত আয়ের পরিমাণ কেমন হতে পারে সেটি পর্যালোচনা করতে হবে। কোম্পানির পূর্বের বিক্রয় ও মুনাফার হার, আয় বৃদ্ধির প্রবনতা, লাভজনকতার সম্ভাবনা ও অন্যান্য আর্থিক অনুপাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ আয় সম্পর্কে অনুমান করা যায়। সেই সাথে ভবিষ্যতে কোম্পানিটি কী ধরণের ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে সেটিও বিবেচনা করতে হবে। যথাযথভাবে ভবিষ্যৎ আয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলোকে অনুমান করা কোম্পানি এনালাইসিসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- সিকিউরিটিজ মূল্যায়ন: ভবিষ্যত আয় অনুমান করার পর একজন বিনিয়োগকারীকে কোম্পানিটির ইস্যুকৃত সিকিউরিটিজের মূল্য কত হওয়া উচিত সেটিও যাচাই করতে হবে। এই মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। একেকজন বিশ্লেষক একেকভাবে মূল্যায়ন করে থাকেন। সাধারনত সিকিউরিটিজ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে “Discounted Cash Flow (DCF)” মডেল ব্যবহার করা সবচেয়ে শ্রেয়। তাছাড়া অনেকে সিকিউরিটিজ মূল্যায়নের জন্য পিয়ার বা তুলনামূলক কোম্পানিগুলোর মূল বাজার অনুপাত অর্থাৎ “Relative Valuation” মডেল ব্যবহার করে থাকেন। এই সম্পর্কিত যথাযথ ধারণা না থাকলে ব্রোকারেজ ফার্মগুলোর রিসার্চ রিপোর্টের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে।
পুঁজিবাজারে সফল হবার জন্য ভালো কোম্পানি খুঁজে বের করে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। তাই বিনিয়োগকারীদেরকে ভালো ও বিনিয়োগযোগ্য শেয়ার বাছাই করার উপায় জানতে হবে। ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে অনেকসময় প্রচুর মুনাফা করতে না পারলেও অন্তত পুঁজি হারানোর ভয় থাকেনা। অতএব বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেবার আগে বিনিয়োগকারীদেরকে কোম্পানির মৌলিক তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে ভালো শেয়ার নির্বাচন করতে হবে।
- No Comments
- June 22, 2022