কীভাবে ব্রোকারেজ ফার্ম নির্বাচন করবেন?
একজন বিনিয়োগকারীর জন্য পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগে একটি দক্ষ ব্রোকারেজ ফার্ম নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রোকারেজ ফার্মের মধ্যস্থতায় একজন বিনিয়োগকারী বিও একাউন্ট খোলে, যার মাধ্যমে সকল প্রকার বিনিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। সংক্ষেপে বলা যায় যে, ব্রোকারেজ ফার্ম হলো একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী সংস্থা যার মাধ্যমে বিনিয়োগকারী বিও একাউন্ট খোলা ও পছন্দমতো বিনিয়োগে (যেমন স্টক, বন্ড, এক্সচেঞ্জ ট্রেড ফান্ড (ইটিএফ) এবং মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি) বিনিয়োগ সম্পাদন করে থাকে এবং প্রদত্ত সেবাসমূহের ( যেমনঃ একাউন্ট ওপেনিং, লেনদেন সম্পাদন, রিসার্চ সাপোর্ট, ফান্ড ট্রান্সফার ইত্যাদি) বিনিময়ে কমিশন গ্রহণ করে।
অন্য যে কোনও ব্যাংক একাউন্টের মতো একজন ব্যবহারকারীকে বিও একাউন্টে টাকা রাখতে হয়। এই একাউন্টের ব্যালান্স স্টক, বন্ড, মিউচুয়াল বন্ড এবং অন্যান্য আর্থিক সম্পদ কেনার জন্য ব্যবহৃত হয়। একটি ব্রোকারেজ ফার্ম ডিজিটাল উপায়ে ক্লায়েন্টদের একাউন্ট সংরক্ষণ করে থাকে এবং এর বিপরীতে ক্লায়েন্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করে। এটি একাউন্টে থাকা সিকিওরিটির জন্য “কাস্টোডিয়ান” হিসাবেও কাজ করে। ব্রোকারেজ ফার্ম বা ব্রোকার ,বিনিয়োগকারী এবং পুঁজিবাজারের মধ্যে একটি মধ্যস্থতাকারী যা বিনিয়োগকারীর নির্দেশ অনুসারে শেয়ার ক্রয় এবং বিক্রয় করে থাকে, এবং বিনিয়োগকারীর সম্পদের সুরক্ষা প্রদান করে থাকে।
সুতরাং আর্থিক সম্পদের নিরাপত্তার জন্য, একটি দক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্রোকারেজ ফার্ম নির্বাচন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিনিয়োগকারী কীভাবে জানবেন যে, কোন ফার্মটি নির্ভরযোগ্য। আজকের ব্লগে আমরা এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি যা আমাদেরকে কোন ব্রোকারেজ ফার্মটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা যাচাই করতে সাহায্য করবে।
ব্রোকারেজ ফার্ম নির্বাচন করার সময় যে বৈশিষ্ট্যগুলি বিবেচনা করতে হবে সেগুলি নীচে আলোচনা করা হয়েছে-
প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ও কার্যপরিচালনার ইতিহাস
কত দিন ধরে সংস্থাটি শেয়ার বাজারে কাজ করছে তা একটি ব্রোকারের আর্থিক সক্ষমতা ও দক্ষতার অন্যতম নির্দেশক। এ ছাড়া ফার্মটিকে ব্রোকার হিসেবে নিয়োগ প্রদানের আগে তাদের কাস্টমারের সংখ্যা ও প্রকারভেদ, লেনদেনের পরিমাণ, ডিজিটালাইজেশন প্রসেস, বিভিন্ন সেবার গুনগত মান ইত্যাদির বিবেচনা করা যেতে পারে। যদি সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক খাতে কাজ করে বা কোন অসংগতি ছাড়াই তার ক্লায়েন্টদেরকে ধারাবাহিকভাবে যথার্থ সেবা সরবরাহ প্রদান করতে সক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে ফার্মটির অন্যান্য দিকগুলো যাচাই করে দেখা যেতে পারে।
পরিচালনা বা মালিকদের পরিচিতি
প্রায়শই যখন কোনও আর্থিক জালিয়াতি ঘটে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পরিচালনা পর্ষদ থেকে কোনও ব্যক্তি বা মালিকরা এই জাতীয় অপরাধমূলক ক্রিয়ায় জড়িত। সুতরাং ব্রোকারেজ ফার্মটি বেছে নেওয়ার আগে একজন ক্লায়েন্টর পরিচালনা পর্ষদ ও কোম্পানির মালিকদের ক্যারিয়ার এবং সমাজে তাদের অবস্থান পরীক্ষা করে দেখা উচিত। এক্ষেত্রে তাদের আর্থিক অবস্থা, ঋণখেলাপি কিনা, অতীতে কোনো অবৈধ কার্যকলাপে সংপৃক্ততা (যদি থাকে) বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
ক্রেডিট রেটিং
ক্রেডিট রেটিং একটি কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতাকে প্রকাশ করে। অতএব ব্রোকারেজ ফার্ম নির্বাচন করার পূর্বে আমাদেরকে দেখতে হবে যে ফার্মটির ক্রেডিট রেটিং করা আছে কিনা এবং ফার্মটিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো এজেন্সি দ্বারা রেটিং করা হয়েছে কিনা। এই রেটিংগুলি বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় যেমন পরিচালনা পর্ষদের গুণগতমান, মূলধন পর্যাপ্ততা, এবং ব্যবসায়ের ঝুঁকি ইত্যাদি। ক্রেডিট রেটিং গ্রেড গুলো কী কী এবং তা দ্বারা কী বোঝানো হয় তা একটি চার্টের মাধ্যমে দেখানো হল-
গ্রেড | বিস্তারিত |
AAA | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটানোর সক্ষমতা অনেক বেশি, এবং ক্রেডিট রিস্ক নেই |
AA1, AA2, AA3 | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটাতে সক্ষম এবং ক্রেডিট রিস্ক খুব কম |
A1, A2, A3 | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটাতে সক্ষম, তবে পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও প্রতিকূল অবস্থার প্রতি সংবেদনশীল। |
BBB1, BBB2, BBB3 | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটাতে যথেষ্ট সক্ষম কিন্তু প্রতিকূল অবস্থা বা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুব বেশি সংবেদনশীল, এছাড়াও মাঝারি শ্রেণীর ক্রেডিট রিস্কও বিদ্যমান। |
BB1, BB2, BB3 | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটানোর সক্ষমতা অপর্যাপ্ত |
B1, B2, B3 | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটাতে দুর্বলতা এবং উচ্চ ক্রেডিট রিস্ক বিদ্যমান |
CCC1, CCC2, CCC3 | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটাতে খুব দুর্বল এবং অত্যন্ত বেশি হারে ক্রেডিট রিস্ক বিদ্যমান |
CC | আর্থিক প্রতিশ্রুতি মেটাতে অত্যন্ত দুর্বল, দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বিনিয়োগকারীর বিনিয়োজিত মূলধন ও সুদ পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা কম। |
C | অর্থ পরিশোধ ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল, দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বিনিয়োগকারীর বিনিয়োজিত মূলধন ও সুদ পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই কম। |
D (DEFAULT) | দেউলিয়া |
ক্রেডিট রিস্ক রেটিং দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্প মেয়াদী উভয়ই হতে পারে। সুতরাং ক্রেডিট রেটিং ব্রোকারেজ হাউসের নির্ভরযোগ্যতার পরিমাপের একটি ভাল মাধ্যম। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত আটটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি বর্তমানে বাংলাদেশে কাজ করছে।
বাংলাদেশে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলির তালিকা-
Credit Rating Information and Services Ltd (CRISL) |
Credit Rating Agency of Bangladesh Ltd (CRAB) |
ARGUS Credit Rating Services Ltd |
Alpha Credit Rating Limited |
Emerging Credit Rating Ltd |
National Credit Ratings Ltd |
The Bangladesh Rating Agency Limited |
WASO Credit Rating Company (BD) Limited |
গ্রাহকের অভিজ্ঞতা বা রেফারেন্স
বর্তমানে সেবা গ্রহণ করছেন এমন গ্রাহক বা ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা রেফারেন্সের ওপর ভিত্তি করে ব্রোকারেজ ফার্মের সেবার মান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এটি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে। ফার্মের দক্ষতা যাচাই করার জন্য, বিদ্যমান ক্লায়েন্টদের সাথে তাদের সেবা গ্রহণের অভিজ্ঞতা এবং ফার্মটি কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।
ফান্ড উত্তোলনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সময়
গ্রাহকের সুরক্ষার বিষয়টি জড়িত থাকায় ফান্ড উত্তোলনের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল হলেও ফার্মটি কত সহজে এবং কতগুলো প্ল্যাটফর্মে (যেমনঃ অনলাইন ও এসএমএসের সাহায্যে ফান্ড রিক্যুইজিশন, মোবাইল এ্যাপ ইত্যাদি) সুবিধাটি প্রদান করছে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। এছাড়াও ক্লায়েন্ট ফান্ড উত্তোলনের নির্দেশনা দেয়ার সাথে সাথে ফার্মটি তা দ্রুততার সাথে কার্যকর করতে পারে কিনা অথবা পারলেও সেক্ষেত্রে কি পরিমাণ সময়ের প্রয়োজন হয় তা ব্রোকারেজ ফার্মের আর্থিক সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক।
ফান্ড ট্রান্সফারে বিকল্প মাধ্যমের সহজলভ্যতা
একটি ব্রোকারেজ ফার্ম তাদের ক্লায়েন্টদের সুবিধার জন্য বিএফটিএন, এনপিএসএম, আরটিজিএস এবং অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে ফান্ড জমা এবং উত্তোলনের জন্য বিভিন্ন বিকল্প প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের সুবিধা দিতে পারে। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে ফান্ড উত্তোলনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সময় এবং কতটা সহজে ও দ্রুততার সাথে গ্রাহকের ফান্ড তার কাছে পৌঁছে দিতে পারে তা ফার্মটির আর্থিক অবস্থা ও দক্ষতার পরিচয় দেয়।
এক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয় যা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে তা হ’ল-
গ্রাহকের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী সেবা প্রদান:
কোনো ব্রোকারেজ ফার্ম বাছাই করার আগে বিনিয়োগকারীকে বুঝতে হবে যে সে কী ধরনের বিনিয়োগ করতে চায়, তার পছন্দের বিনিয়োগ সম্পর্কে বিনিয়োগকারী কতটা জ্ঞান রাখেন এবং তিনি কী ধরনের ব্রোকারেজ ফার্মের সন্ধান করছেন।
ব্যয় অনুপাতে সেবার তুলনামূলক বিশ্লেষণ:
ব্রোকারেজ ফার্ম প্রদত্ত সেবাসমূহের ( যেমনঃ একাউন্ট ওপেনিং, লেনদেন সম্পাদন, রিসার্চ সাপোর্ট, ফান্ড ট্রান্সফার ইত্যাদি) বিনিময়ে কীরূপ হারে কমিশন গ্রহণ করে থাকে।
বিনিয়োগের ধরণ:
দক্ষ ব্রোকারেজ ফার্ম বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগের ধরণের (স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী) উপর নির্ভর করে। একজন বিনিয়োগকারী যদি স্বল্পমেয়াদে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা লাভ করতে চান সেক্ষেত্রে তার ট্রেডিং ফি কম চার্জ করে এমন ব্রোকারেজ ফার্ম নিয়োগ করা উচিত। আবার যদি দীর্ঘমেয়াদের জন্য তার সঞ্চিত অর্থ কোন প্রগতিশীল কোম্পানীর শেয়ারে বিনিয়োগ করতে চান, সেক্ষেত্রে তার দীর্ঘমেয়াদের সেবা প্রদানে দক্ষ এমন ব্রোকারেজ ফার্ম বেছে নেওয়া উচিত।
সেবার গুণগত মান এবং বিভিন্ন প্রকার ছাড়:
ব্রোকারেজ ফার্ম গুলি তাদের ক্লায়েন্টদের কাছে কী ধরনের সেবা প্রদান করছে এবং কোন কোন সেবা খাতে ছাড় প্রদান করছে তা বিবেচনা করা যেতে পারে।
রিসার্চ সাপোর্ট:
ব্রোকারেজ ফার্ম কীভাবে তাদের গ্রাহকদের- ভিডিও, পডকাস্ট,সোশাল মিডিয়া, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে এবং সেই তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা এবং গুণমান যাচাইয়ের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা যাচাই করা যেতে পারে।
কত সহজে ফান্ড ট্রান্সফার করা যায়:
একজন বিনিয়োগকারী তার নিজস্ব বিও একাউন্ট থেকে কত সহজে এবং দ্রুততার সাথে ফান্ড ট্রান্সফার করতে পারেন তাও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় তথ্যের সহজলভ্যতা:
ক্লায়েন্ট তার যাবতীয় লেনদেনের তথ্য, লেজার ব্যলেন্স, পোর্টফলিও সংকান্ত তথ্য নিয়মিত ভাবে পায় কিনা, তথ্যের আদানপ্রদানে নিয়োজিত মাধ্যম সমূহ যেমনঃ ই-মেইল, সোশাল মিডিয়া, এসএমএস , মোবাইল এ্যাপ ইত্যাদি ক্লায়েন্টরা সহজে ব্যবহার করতে পারছে কিনা তা বিবেচনা করা যেতে পারে।
ব্রোকারেজ ফার্ম নির্বাচন করা বিনিয়োগের জগতে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার মতো। একটি দক্ষ ব্রোকারেজ ফার্ম নির্বাচনের মাধ্যমে, বিনিয়োগকারীরা তার কাঁধের সমস্ত অপ্রয়োজনীয় বোঝা থেকে মুক্তি পেতে পারেন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের শক্তি ও সময় ব্যয় করতে পারেন।
তবে আর অপেক্ষা কেন?
উপরের বিষয়গুলো বিবেচনা করে আজই আপনার পছন্দের ব্রোকার নির্বাচন করুন।