চার্ট প্যাটার্ন ভিত্তিক টেকনিকাল এনালাইসিস: টেকনিকাল এনালাইসিস পর্ব ৩
টেকনিক্যাল এনালাইসিসের মাধ্যমে শুধুমাত্র চার্ট এনালাইসিস করে আপনি একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম সম্পর্কে ধারণা নিতে পারবেন। একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে যাচ্ছে এটি আপনি ঐ কোম্পানির শেয়ারের চার্ট দেখলেই বুঝতে পারবেন যে কোম্পানির শেয়ারের দাম কমছে কিন্তু ঠিক কি কারণে ঐ কোম্পানির শেয়ারের দাম কমছে তা আপনাকে জানতে হচ্ছে না । কোম্পানির ব্যবসায়িক যেসব কারণে শেয়ারের দাম কমতে পারে যেমন কোম্পানি ভালোভাবে পরিচালিত না হওয়া বা কোম্পানি সম্পর্কে খারাপ নিউজ আসা সেসব সম্পর্কে আপনাকে চিন্তা করতে হচ্ছে না ।
তাই যখন একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে বা কমতে শুরু করে আপনি কোন ধরনের ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস ছাড়াই ট্রেন্ডের শুরু থেকে ট্রেন্ডের পক্ষে ট্রেড করতে পারবেন।তবে অনেক বিনিয়োগকারী টেকনিক্যাল এনালাইসিস এবং ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস দুটি করতে পছন্দ করেন।
ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস সবচেয়ে বেশি জরুরি তাদের জন্য যারা অনেক দীর্ঘ সময় ধরে শেয়ার ধরে রাখেন।
১.চার্ট প্যাটার্ন কি :
চার্ট প্যাটার্ন হচ্ছে চার্টে তৈরি হওয়ার নির্দিষ্ট কিছু ফর্মেশন বা প্যাটার্ন যার সাহায্যে টেকনিক্যাল এনালিস্টরা একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ভবিষ্যতে বাড়বে নাকি কমবে তা ধারণা করেন।ক্যান্ডেলস্টিক চার্টে প্রাইস পয়েন্টের মধ্যে দাগ টেনে টেকনিক্যাল এনালিস্টরা চার্ট প্যাটার্ন নির্ণয় করে থাকেন। কিছু প্যাটার্ন খুবই সাধারণ হয় যা শুধু ট্রেন্ড লাইন দিয়ে আঁকা যায় আবার কিছু প্যাটার্ন জটিল হয়ে থাকে।টেকনিকাল্ এনালাইসিসে একটি কোম্পানীর শেয়ারের মূল্যের আপট্রেন্ড থেকে ডাউনট্রেন্ডে পরিবর্তন সাধারনত চার্ট প্যাটার্ন এর মাধ্যমে নির্দেশিত হয়।
২. চার্ট প্যাটার্ন এনালাইসিস :
চার্ট প্যাটার্ন এনালাইসিস একটি বিশেষ ধরনের টেকনিক্যাল এনালাইসিস যেখানে টেকনিক্যাল এনালিস্টরা চার্টের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট প্যাটার্ন দেখে সাপোর্ট রেজিস্ট্যান্স নির্ধারন করে থাকেন ।চার্ট প্যাটার্ন এনালাইসিস করে বিনিয়োগকারীরা কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনার সুযোগ বের করেন এবং তাদের ক্রয়কৃত শেয়ার অধিক মুনাফায় বিক্রি করার উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করেন।
এই প্যাটার্ন গুলোর মধ্যে বেশ কিছু সাইকোলজিকাল ফ্যাক্টর কাজ করে থাকে যেমন একটি স্ট্রং রেজিস্টেন্স থেকে প্রাইস ড্রপ করার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে স্ট্রং রেজিস্টেন্স থেকে যদি প্রাইস উপরে উঠে যায় তাহলে এটির আরো উপরে উঠার সম্ভাবনা থাকে। যেমন অ্যাসেন্ডিং ট্রায়াঙ্গেল একটি বুলিশ চার্ট প্যাটার্ন যেটি রেজিস্ট্যান্স এরিয়াতে দেখা যায় এবং এটি ব্রেক করে উপরে উঠলে প্রাইজের আরো উপরে উঠার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।ট্রেডারদের জন্য ট্রেন্ড রিভারসাল প্যাটার্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ রিভারসাল প্যাটার্ন, কখন ট্রেড থেকে প্রফিট নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে এবং কখন একটি নতুন এন্ট্রিতে প্রবেশ করতে হবে তা বুঝতে সহায়তা করে।
৩.চার্ট প্যাটার্ন এর প্রকারভেদ:
চার্ট প্যাটার্ন সাধারনত দুই ধরনের হয়ে থাকে।
ক. রিভার্সাল প্যাটার্ন : রিভারসাল প্যাটার্ন চার্টে ট্রেন্ড দিক পরিবর্তন করতে চলেছে এটি নির্দেশ করে। একটি আপট্রেন্ডে প্রাইস ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু যখনই টেকনিক্যাল এনালিস্ট একটি আপট্রেন্ডে রিভার্সাল প্যাটার্ন দেখতে পান তখন তিনি বুঝতে পারেন যে আপট্রেন্ড শেষ হতে চলেছে এবং নতুন ডাউনট্রেন্ড শুরু হতে পারে।
একটি কোম্পানির শেয়ার যখন বিনিয়োগকারীরা কিনতে থাকেন তখন একটি আপট্রেন্ড সৃষ্টি হয়। একটি চলমান আপট্রেন্ডে যখন বিনিয়োগকারীরা দেখেন যে শেয়ারের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা বিক্রি করে দেওয়াই লাভজনক হবে তখন তারা ক্রমাগত শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন ।তখন নতুন করে ওই কোম্পানির শেয়ার আর কেউ কিনতে চায় না অর্থাৎ মার্কেটে আপ ট্রেন্ডে চলমান থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্রেতা থাকে না তাই তখন রিভার্সাল চার্ট প্যাটার্ন তৈরি হয়ে থাকে।
টেন্ড রিভার্সাল ফান্ডামেন্টাল যে কারণেই হয়ে থাকুক চার্টে রিভার্সাল প্যাটার্ন তৈরি করা ছাড়া সাধারণত কোন ট্রেন্ডই দিক পরিবর্তন করে না। তাই রিভার্সাল প্যাটার্ন ভালো করে আয়ত্ত করতে পারলে ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস ছাড়াই একজন ট্রেডার বুঝতে পারবে কখন তার ক্রয়কৃত শেয়ার অধিক মুনাফায় বিক্রি করে দেওয়ার উত্তম সময়।একজন ট্রেডার যখন কোনো কোম্পানির শেয়ারে রিভার্সাল প্যাটার্ন দেখতে পান তিনি যদি ওই শেয়ারটি আগে কিনে থাকেন তাহলে তা বিক্রি করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেন।
আপ ট্রেন্ডের চূড়ায় যখন রিভার্সাল প্যাটার্ন তৈরি হয় তাকে ডিস্ট্রিবিউশন(distribution) প্যাটার্ন বলে। এখানে বিনিয়োগকারীরা নতুন শেয়ার কেনার থেকে বিক্রি করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অপরদিকে একই ডাউনট্রেন্ডে শেষভাগে তৈরি হওয়া রিভারসাল প্যাটার্নকে একোমুলেশন(accumulation) প্যাটার্ন বলে যেখানে শেয়ার বিক্রি করা থেকে নতুন শেয়ার কেনাই বেশি যুক্তিসংগত।
নিচে টেকনিকাল এনালাইসিসে বহুল ব্যবহৃত রিভার্সাল প্যাটার্ন এর তালিকা দেয়া হলোঃ
– ডাবল টপ রিভার্সাল(Double Top Reversal)
– ডাবল বটম রিভার্সাল (Double Bottom Reversal)
– হেড এন্ড শোল্ডার টপ (Head and Shoulder top)
– হেড এন্ড শোল্ডার বটম (Head and Shoulder Bottom)
– ফলিং ওয়েজ (Falling Wedge)
– রাইজিং ওয়েজ (Rising Wedge)
– রাউন্ডিং বটম (Rounding Bottom)
– ত্রিপল টপ রিভার্সাল (Tripple Top Reversal)
-ত্রিপল বটম রিভার্সাল (Tripple Bottom Reversal)
-বাম্প এন্ড রান রিভার্সাল (Bump and Run Reversal)
খ. কন্টিনিউয়েশন প্যাটার্ন : কন্টিনিয়েশন প্যাটার্ন তৈরি হলে কোনো একটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বর্তমানে যে ট্রেন্ডে চলমান রয়েছে ভবিষ্যতেও একই ট্রেন্ডে চলমান থাকার সম্ভাবনা বুঝায়। আপট্রেন্ডে যখন কোনো একটি কোম্পানির শেয়ার কন্টিনিউয়েশন চার্ট প্যাটার্ন দেখায় তখন তা নিকট ভবিষ্যতে আপট্রেন্ডেই চলবে তা নির্দেশ করে। একইভাবে ডাউনট্রেন্ডে যখন একটি কোম্পানির শেয়ার কন্টিনিউয়েশন প্যাটার্ন দেখায় তখন তার নিকট ভবিষ্যতে ডাউন ট্রেন্ডে চলার সম্ভাবনা প্রকাশ করে।
আপট্রেন্ডে শুধুমাত্র কন্টিনিউয়েশন প্যাটার্ন তৈরি হলেই কখনো নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না যে প্রাইস আপ ট্রেন্ডে চলবে।তাই টেকনিকাল এনালিস্টরা চার্ট প্যাটার্ন তৈরি হওয়া ও ব্রেকআউট হওয়ার পর নিশ্চিত হন যে প্রাইজ আপট্রেন্ডেই চলবে। তাই আমাদের চার্ট প্যাটার্ন আঁকার সময় সতর্ক থাকতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে প্রাইস পূর্বের ট্রেন্ডের দিকেই ব্রেক আউট হয়েছে কিনা। একটি প্যাটার্ন তৈরি হতে যত বেশী সময় নেয় ঐ প্যাটার্নের ব্রেকআউট এর কারণে প্রাইজের মুভমেন্টও তত বেশি হয়।
একটি আপট্রেন্ডে যখন একজন ট্রেডার কন্টিনিউয়েশন প্যাটার্ন দেখতে পান তিনি যদি কোম্পানির শেয়ার আগে থেকেই কিনে থাকেন তাহলে তা দীর্ঘ সময় ধরে রাখেন।এছাড়াও আপট্রেন্ডে কন্টিনিউয়েশন প্যাটার্ন কোনো একটি কোম্পানীর শেয়ার নতুন করে কেনার সুযোগও তৈরি করে দেয়। একজন বিনিয়োগকারী যদি একটি সম্ভাবনাময় কোম্পানীর শেয়ার আগে কোনো কারণে কিনতে না পারেন,তিনি আপ্ট্টট্রেন্ডে কন্টিনিউয়েশন প্যাটার্ন দেখলে ঐ কোম্পানীর শেয়ার কেনার একটি ভালো সুযোগ পান।
নিচে টেকনিকাল এনালাইসিসে বহুল ব্যবহৃত কন্টিনিউয়েশন প্যাটার্ন এর তালিকা দেয়া হলোঃ
-ফ্ল্যাগ প্যাটার্ন (Flag Pattern)
-পেন্যান্ট প্যাটার্ন (Pennant pattern)
-এসেন্ডিং ট্রায়াংগেল (Ascending Triangle)
-ডিসেন্ডিং ট্রায়াংগেল (Descending Triangle)
-রেক্টেংগেল (Rectangle)
-প্রাইজ চ্যানেল (Price channel)
-মেসার্ড মুভ-বুলিশ (Measured Move – Bulish)
-মেসার্ড মুভ-বেয়ারিশ (Measured Move-Bearish)
-কাপ উইথ হ্যান্ডেল (Cup with handle)
৪.চার্ট প্যাটার্ন নির্ণয়ে ট্রেন্ড লাইনের ভূমিকা:
টেকনিক্যাল এনালিস্টরা চার্ট প্যাটার্ন এনালাইসিস করেন কয়েকটি ট্রেন্ড লাইনের সাহায্যে। তাই আপনাকে চার্ট প্যাটার্ন আঁকা শিখতে হলে প্রথমে ট্রেন্ডলাইন আঁকা শিখতে হবে। ট্রেন্ডলাইন টেকনিক্যাল এনালিস্টদের চার্টের মধ্যে সাপোর্ট এন্ড রেজিস্টেন্স এরিয়া চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
একটি আপট্রেন্ডে প্রাইস ক্রমাগত হায়ার হাই(Higher High) এবং হায়ার লো(Higher Low) তৈরি করে বৃদ্ধি পায়। আপ ট্রেন্ডে বিক্রেতার থেকে ক্রেতার সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে তাই প্রাইস ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।একটি আপ ট্রেন্ডের মধ্যে সাধারণত আপ ট্রেন্ডলাইন আঁকা হয়। আপ ট্রেন্ডে তৈরি হওয়া ক্যান্ডেলস্টিক এর নিম্নপ্রান্ত গুলোর গা ঘেঁষে বা ন্যূনতম দুইটি লো( Low) কে যোগ করে ট্রেন্ড লাইন আঁকা হয়ে থাকে।তিনটি বা এর অধিক হাই বা লো যোগ করে আঁকা ট্রেন্ডলাইন্ অধিক গ্রহনযোগ্য হয়।
একটি ডাউনট্রেন্ডে প্রাইস ক্রমাগত লোয়ার হাই এবং লোয়ার লো তৈরি করে কমতে থাকে নিচে নামে। ডাউন ট্রেন্ডের মধ্যে ন্যূনতম দুইটি লোয়ার হাই কে যুক্ত করে ডাউন ট্রেন্ড লাইন আঁকা হয়।
রেঞ্জিং মার্কেটে বা সাইডওয়ে মার্কেটে প্রাইস একটি নির্দিষ্ট আপার রেঞ্জ এবং লোয়ার রেঞ্জের মাঝেই উঠানামা করতে থাকে। ট্রেন্ড লাইন দিয়ে প্রাইস এর আপার রেঞ্জ ও লোয়ার রেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়।
ডেইলি চার্টে ট্রেন্ডলাইন আঁকার জন্য টেকনিকাল এনালিস্টরা ক্যান্ডেলের ক্লোসিং প্রাইস ঘেঁষে ট্রেন্ডলাইন আকা বেশী সমর্থন করেন। কারণ্ ক্লোসিং প্রাইজ দিনশেষে বিনিয়োগকারীদের কোনো একটি কোম্পানির শেয়ার ধরে রাখা কিংবা বিক্রি করে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
সর্বশেষে বলা যায়,ট্রেডিং এ ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস থেকে টেকনিকাল এনালাইসিস বেশী জরুরী। কারণ ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস এ কোম্পানির যেসব বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তার প্রভাব কোম্পানির শেয়ারের দামে পড়তে অনেকটা সময় লাগে ।তাই সঠিক ভাবে টেকনিকাল এনালাইসিস করার জন্য চার্ট প্যাটার্ন এনালাইসিস শিখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টেকনিকাল এনালাইসিস এর পূর্বের দুটি পর্ব পড়তে –
ট্রেন্ড সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা : টেকনিকাল এনালাইসিস পর্ব ২
টেকনিকাল এনালাইসিসের প্রাথমিক ধারণা : টেকনিকাল এনালাইসিস পর্ব ১