বন্ড সমাচার
বন্ড সমাচার
বন্ড কি এবং এর ধরণ
বন্ড হচ্ছে এক ধরনের ঋণপত্র। এই ঋণপত্র ছেড়ে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে । বৃহৎ অর্থে পুঁজিবাজারে সাধারণত দুই ধরনের বন্ড দেখা যায়- সরকারি বন্ড ও কর্পোরেট বন্ড। বিভিন্ন কোম্পানির ইস্যু করা বন্ডগুলোকে বলা হয় কর্পোরেট বন্ড। এবং মিউনিসিপ্যাল ও ট্রেজারি বন্ড হলো সরকার কতৃক ইস্যুকৃত বন্ড। ট্রেজারি বন্ড হলো সরকারি বন্ড, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। যার মেয়াদ ন্যূনতম দুই বছর থেকে বিশ বছর। জাতীয় বাজেটকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইস্যু করে থাকে। প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকগুলো সাধারণত অকশন পদ্ধতির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ট্রেজারি গুলো কিনে থাকে। বর্তমানে স্টক এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে যে কোন বিনিয়োগকারী ট্রেজারি বন্ডের অকশনে অংশগ্রহণ করতে পারে। ২০০৫ সাল থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ -এ ট্রেজারি বন্ড তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে বাজারে মোট ৪ মেয়াদের বন্ড রয়েছে- ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর এবং ২০ বছর। পুজিবাজার অন্তর্ভুক্ত ট্রেজারি বন্ড রয়েছে ২৫০ টি। ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে এগুলোর মেয়াদকাল। ট্রেজারি বিল তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের হয়ে থাকে। এটির যে প্রকৃত মূল্য, তার চেয়ে কম মূল্যে বা ডিসকাউন্টে সরকার এটি বিক্রি করে। ফলে ক্রেতা পরবর্তীতে পূর্ণ মূল্যে বিক্রি করে এর থেকে মুনাফা করে থাকেন। বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। বন্ডের ইউনিটের ফেসভ্যালু ধরা হয় ১০০ টাকা। লট হিসাব করা হয় দশ হাজারটি । এছাড়াও দেশের শেয়ার বাজারে কর্পোরেট বন্ড রয়েছে ১১ টি।
এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অরেঞ্জ বন্ড, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য পিংক বন্ড চালুর পরিকল্পনা ও নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য স্টার্টআপ বোর্ড তৈরির কাজ চলছে। বন্ডে লভ্যাংশ সুদ আকারে নির্দিষ্ট পরিমাণে দেয়া হয়। কিছু কিছু কোম্পানি সুদের পরিবর্তে মূল লভ্যাংশেরও একটি অংশ বিনিয়োগকারীদের দিয়ে থাকে। শরীয়াহভিত্তিক বন্ড গুলো নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ না দিয়ে লভ্যাংশ দিয়ে থাকে- যা সুকুকু নামে পরিচিত। তবে এটি নির্ভর করছে বন্ডের ধরন ও প্রকৃতির ওপরে। প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশে ১৯৮৮ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড এবং ২০০২ সালে তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড চালু করা হয়। বন্ড বাজারে স্বচ্ছতা সম্পর্কে ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরির সহযোগীতার জন্য চালু সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন চালু করেছে বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম ।
বন্ড মার্কেটঃ একটি সম্ভাবনাময় খাত
বন্ড খুবই সম্ভাবনাময় একটি খাত। বাংলাদেশে বন্ড মার্কেট গতিশীল হলে অর্থনীতিতে এটা বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট মূলত সরকারী বন্ড নির্ভর। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে হারে বাড়ছে সে গতি ধরে রাখতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য বড় ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল দরকার।বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, দেশের ব্যাংক খাত অবস্থা ‘সন্তোষজনক’। দেশের ৫৭ টি ব্যাংকের ২০১৯ জুন ৩০ ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১০টি ব্যাংক প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছে। আর ৯টি ব্যাংকের অবস্থা ‘মোটামুটি ভালো’। বাকি ৩৮টি ব্যাংকের অবস্থা ‘সন্তোষজনক’। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিচারে দেশে ‘শক্তিশালী’ মানের কোনো ব্যাংক নেই। আবার একেবারেই ‘অসন্তোষজনক’ ক্যাটাগরিতে কোনো ব্যাংক পড়েনি। ক্যামেলস রেটিং হচ্ছে ব্যাংকের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিমাপের মানদণ্ড। এ অবস্থায় ব্যাংকের অর্থায়নের মাধ্যমে দেশের আর্থিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন। সর্বপরি ব্যাংকগুলোর জন্য স্বল্পমেয়াদে আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয়া কঠিন। অন্যদিকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়ে শিল্প পুরোদমে চালুর আগেই অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন উদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠান অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলাপি হয়ে যায়। তাই দীর্ঘমেয়াদী ঋণের বিকল্প উৎস হিসেবে বন্ড মার্কেট অপরিহার্য। অন্যদিকে বন্ড মার্কেটের পরিসর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বন্ড মার্কেটে ট্রেজারি বন্ডে মোট ইস্যুকৃত ক্যাপিটাল রয়েছে ৩১৬৯৯৯৫মিলিয়ন টাকা এবং কর্পোরেট বন্ডে মোট ইস্যুকৃত ক্যাপিটাল রয়েছে ৪০৫০০ মিলিয়ন টাকা । দশ মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডে সুদের হার ৮.৩৩%। কর্পোরেট বন্ড এর গড় সুদের হার ৮.৮৯%।
(তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশ ব্যাংক)
বিনিয়োগকারীরা কেন বন্ড কিনবে
বন্ডের ক্ষেত্রে সুদের হার নির্দিষ্ট থাকে ফলে বিনিয়োগকারীদের আয়ও নির্দিষ্ট থাকে। সাধারণত বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানকে বন্ডের বিপরীতে স্থায়ী ও অন্যান্য সম্পত্তি জামানত হিসাবে রাখতে হয়।ফলে বন্ডের বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকে। এছাড়া ব্যংকের সুদের হারের তুলনায় বন্ডের সুদের হার বেশী হওয়ায়, বন্ডে বিনিয়োগে লাভ বেশি হয়।
বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটের তুলনামূলক অবস্থান
জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ-আফ্রিকা, চীন, থাইল্যান্ড, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামসহ অনেক দেশের চেয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বাংলাদেশের বন্ড মার্কেটের অনুপাত অনেক নিচে। যেখানে জাপানে এ হার জিডিপির ২৪১ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ১৬৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুরের ১১৫ শতাংশ, প্রতিবেশী দেশ ভারতের ৪৯ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে ৮ শতাংশ। এই ৮ শতাংশের মধ্যে ৭ দশমিক ৯ শতাংশই সরকারি পর্যায়ের বন্ড। বেসরকারি খাতে বন্ডের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে বন্ডের অবদান মাত্র ১০.৪১% শতাংশ। ইতোমধ্যে দেশের পুঁজিবাজারে ১৩ হাজার কোটি টাকার সরকারি বন্ডের লেনদেন চালু হয়েছে। সম্প্রতি ইস্যু করা বেশিরভাগ বন্ডের মাত্র ১০ শতাংশ সাধারণ মানুষের জন্য রাখা হয়েছে। বাকি ৯০ শতাংশ প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, যেটা সাধারণভাবে লেনদেন হয় না। বন্ড বাজারকে জনপ্রিয় করতে হলে সাধারণ লেনদেন বাড়াতে হবে। এছাড়া বন্ডের পরিসর বাড়ালে পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ বাড়বে। শেয়ারবাজারে যেখানে লোকসানের আশঙ্কা থাকে, বন্ড বাজারে এক অর্থে সেরকম কিছু না থাকায়, আর্থিক সুবিধা পায় এর ক্রেতারা। অন্যদিকে ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়লে বাজারে বন্ড ছেড়ে ছোট ছোট কোম্পানি খুঁজে পাবে মূলধনের জন্য বিনিয়োগ। তবে এখানে সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে সীমাহীন বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় । এছাড়া বন্ড বাজার উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় দ্বার খুলে দিচ্ছে ।
তথ্যসূত্রঃ https://www.deshrupantor.com
প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বন্ডে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডলারে তিন বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারে। এগুলো হলো; ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড। এসব বন্ড বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস, দেশি ব্যাংকের বিদেশি শাখা ও বাংলাদেশের ব্যাংক শাখায় পাওয়া যায়। বন্ড কিনতে ফরেন কারেন্সি বা বৈদেশিক মুদ্রায় (এফসি) হিসাব থাকারও বাধ্যবাধ্যকতা নেই।
এসব বন্ডের বিপরীতে দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন প্রবাসীরা। বিনিয়োগ করা অর্থ চাইলে আবার বিদেশেও ফেরত নেয়া যায়। এসব বন্ডে বিনিয়োগ করে সিআইপি সুবিধার পাশাপাশি আয়ে করমুক্ত সুবিধাও পাওয়া যায়।
ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড থেকে বিনিয়োগের পরিমান ও এর মেয়াদ ভিত্তিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পাওয়া যায়।
এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের চালু করা ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড নামে আরও একটি বন্ড রয়েছে। তবে এ বন্ডের মুনাফার হার ও স্তর কমানোর কথা কিছুই বলা হয়নি। এ বন্ডে ৫ বছর শেষে মুনাফার হার ১২ শতাংশ।
তথ্যসুত্রঃ https://www.prothomalo.com/business/personal-finance
- No Comments
- September 27, 2023